কৃষির সমৃদ্ধি আনতে এবং এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পাহাড়ি কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের এক-দশমাংশ এলাকাজুড়ে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা নিয়ে পার্বত্য অঞ্চল গঠিত। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মতে এক ইঞ্চি জমিও যেন খালি না থাকে, পাহাড়ি অঞ্চলেও সেটার বাস্তবায়ন জরুরি। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কৃষির উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার ওপর বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের তাগিদ রয়েছে। কৃষিকে লাভজনক ও রপ্তানিমুখী বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করাও বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য।
পার্বত্য অঞ্চল জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানে আছে উঁচু-নিচু পাহাড়, ভ্যালি, বন, হ্রদ, জলপ্রপাত, পাহাড়ি ঝরনা, নদী, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, প্রাণী ও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। এখানে অ-উপজাতি ও উপজাতীয়দের মধ্যে একটা সম্প্রীতির বন্ধন কাজ করে। দেশের ২৯টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ১৩টি সম্প্রদায় এখানে বাস করে। তাদের প্রত্যেকের কৃষ্টি-কালচার এবং জীবনযাত্রাও আলাদা ও বৈচিত্র্যময়। এখানকার ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনাও ভিন্নতর। পাহাড়ি কৃষি বিভিন্ন দিক দিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ।
পাহাড়ি অঞ্চলের কৃষিকে বৃহৎ অর্থে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে যথা (১) আপল্যান্ড বা উচ্চভূমির কৃষি, যেমন জুম চাষ ও উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের আবাদ বা মিশ্র ফলদ বাগান সৃজন; (২) ভ্যালি বা সমতল ভূমির কৃষি; (৩) এগ্রো-ফরেস্ট্রি (৪) প্রাণিসম্পদ পালন ও (৫) ঝিরিতে বা হ্র্রদে মাছ চাষ। এছাড়া আরো বিভিন্নরকম খামার পদ্ধতি রয়েছে যেমন ফ্রিঞ্চ ল্যান্ড এগ্রিকালচার, যাকে জলে ভাসা কৃষি বলা হয়। কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে জমি ভেসে উঠলে সেখানে ধানসহ বিভিন্ন সবজি-ফসলের আবাদ করা হয়। এছাড়া রয়েছে রাবার প্লান্টেশন, আগর প্লান্টেশন ইত্যাদি।
জুম চাষ বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতি। বেশির ভাগ উপজাতি সম্প্রদায়ের জীবিকার অন্যতম উৎস। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে ঢালু পাহাড়ের ওপর জুম চাষ করা হয়। কয়েক বছর (বর্তমানে ১-৩ বছর) পরপর পাহাড় পরিবর্তনের মাধ্যমে চাষাবাদ করা হয় বলে ইংরেজিতে একে শিপ্টিং কালটিভেশন বলে। জুমের ফলন কম হওয়া এবং জুম চাষের জন্য পর্যাপ্ত জমি না পাওয়ার কারণে বর্তমানে অনেকে জুম চাষ থেকে সরে এসে মিশ্র ফলদ বাগান বা অন্যান্য পেশার দিকে ঝুঁকছে। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাদের বসবাস তারা বেশির ভাগ সার্বিকভাবে জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল।
জুম চাষ বলতে পাহাড়ের জঙ্গল কেটে শুকিয়ে তারপর পুড়িয়ে পরিষ্কার করে ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ করাকে বোঝায়। ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে জঙ্গল কেটে, শুকিয়ে নেয়। তারপর পুড়িয়ে পরিষ্কার করে। প্রথম বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর এপ্রিল-মে মাসে প্রায় সব ফসলের বীজ বপন করা হয়। বিভিন্ন ফসল আষাঢ় থেকে অগ্রহায়ণের মধ্যবর্তী সময়ে পরিপক্ব হয় এবং পর্যায়ক্রমে সেগুলো সংগ্রহ করা হয়। জুমের ফসলের মধ্যে স্থানীয় উফশী জাতের ধান, মিষ্টি কুমড়া, মারফা, চিনাল, অড়হর, শিম, শসা, করলা, ঢেঁড়স, তিল, ভুট্টা, মরিচ, কাউন, বিলাতি ধনিয়া, করলা, বরবটি, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, চাল কুমড়া, কাঁকরোল, পুঁইশাক, জুমকচু, মুখিকচু, বেগুন, লাউ, ধুন্দল, আদা, হলুদ, যব, তুলা, পাহাড়ি আলু, যা ঠান্ডা আলু হিসেবে পরিচিত, চুকুর, জোয়ার, গাঁদা ফুল ইত্যাদি।
আপল্যান্ড এগ্রিকালচারের মধ্যে বর্তমানে মিশ্র ফলদ বাগানই প্রধান ভূমিকা রাখছে। ভ্যালি বা সমতল কৃষি বলতে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী জায়গায় সমতল ভূমিতে চাষাবাদ করাকে বোঝায়। বন্যা বিধৌত ও ভ্যালি ভূমির পরিমাণ প্রায় ২৭০৮১২ হেক্টর যা সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলের শতকরা ৩ দশমিক ২ ভাগ। যার মাত্র শতকরা ১৯ ভাগ জমিতে সেচ সুবিধা বিদ্যমান। এখানের প্রধান শস্য পর্যায় হলো বোরো ধান-পতিত-বোনা আমন এবং সবজি-বোনা আউশ-বোনা আমন। আউশ প্রধানত জুমেই চাষ হয়। ভ্যালিতে প্রধানত আমন ধান, বোরো এবং শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন সবজিসহ তুলা ও আখ আবাদ হয়।
পাহাড়ে অনেক প্রাকৃতিক ঝরনা আছে, ক্রিক জলাদার আছে, কাপ্তাই লেক আছে, অনেক জায়গায় পুকুর আছে। সেসব জায়গায় মাছ চাষের সুযোগ রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (২০১৩) তথ্যমতে তিন পার্বত্য জেলায় ৬৫৯টি ওয়াটারশেড রয়েছে যার মধ্যে খাগড়াছড়িতে ১১৯টি, রাঙ্গামাটিতে ২৭৩ ও বান্দরবানে ২৬৭টি। আর ক্রিক রয়েছে ৪৫৭৩টি যার মোট আয়তন ১৫৩৭ হেক্টর। এসব ওয়াটারশেড ও ক্রিকে প্রকল্পের মাধ্যমে টেকসই বাঁধ দিয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা যেতে পারে। ওই পানি বাগানের সেচ কাজে, গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করতে পারে। তবে বাঁধের পানির সুষ্ঠু বণ্টন ও ব্যবহার নিশ্চিত জরুরি। রাঙ্গামাটির কাপ্তাই লেক একটি বৃহৎ জলাভূমি যা বর্ষাকালে ৬৮৩০০ হেক্টর এবং শুষ্ক মৌসুমে ৫৮০০ হেক্টর জায়গাজুড়ে পানি থাকে। সেখানে মাছ উৎপাদন গড়ে প্রতি হেক্টরে মাত্র ১৩০ কেজি যা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। কাপ্তাই হ্রদে কেজ এবং প্যান কালচার পদ্ধতি চালু করতে পারে, যা ফিলিপাইনে বড় বড় হ্রদে দেখতে পাওয়া যায়।
পাহাড়ে প্রাণিসম্পদ যেমন হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, ভেড়া, গয়াল ও শূকর পালন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চট্টগ্রাম এনিম্যাল অ্যান্ড ভেটেরিনারি সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে এর ওপর একটি প্রকল্পও চলমান আছে। পাহাড়ি এলাকায় প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের জন্য কমিউনিটি ভিত্তিক এনিম্যাল হেলথ কেয়ার স্থাপন, গরু, ছাগল ও ভেড়ার জন্য এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন) সার্ভিস জোরদারকরণ দরকার, উপজাতি সম্প্রদায়ের জন্য পরিবারভিত্তিক শূকর পালন, গোচারণ ভূমি কমে যাওয়ার কারণে ঘাস (ফডার) চাষাবাদের ওপর জোর দেয়া দরকার। লাইভস্টক কাম এগ্রো-ফরেস্ট্রি একটি উত্তম খামার পদ্ধতি বলে বিবেচিত যা নেপাল, ভুটান, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনে দেখা যায়। এটা চালু করতে পারলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান বাড়বে।
পাহাড়ি কৃষির প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হলো কৃষি পেশাকে লাভজনক পেশায় পরিণত করা। এর জন্য অনেক ফ্যাক্টর দায়ী যেমন ফসলের উৎপাদনশীলতা কম, শুষ্ক মৌসুমে তীব্র পানির সংকটে সেচের অভাব, জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে নানা ধরনের রোগ ও পোকার আক্রমণ, অতি বৃষ্টি এবং অতি উষ্ণতা, মাটির উর্বরা শক্তি কম, মাটি ক্ষয় হওয়া, ভূমিধস, জীববৈচিত্র্য কমে যাওয়া, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানসম্মত কৃষি উপকরণ সহজলভ্য না হওয়া, উপকরণ ব্যবহারে দক্ষতা ও জ্ঞানের স্বল্পতা, পণ্য সংগ্রহোত্তর জ্ঞানের স্বল্পতা, পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া, মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে স্বল্পতা, উত্তম কৃষিচর্চার অনুপস্থিতি, প্রক্রিয়াকরণের সুযোগ না পাওয়া, কালেকশন সেন্টার ও সংরক্ষণাগার না থাকা।
ক্ষুদ্র কৃষকদের বড় বাজারে প্রবেশাধিকার সীমিত, কৃষকদের দরকষাকষি ক্ষমতা কম, বিদ্যমান কৃষক সংগঠনগুলোর কার্যকর দক্ষতার অভাব, মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য, পণ্য বিক্রির নির্দিষ্ট স্থান না থাকা, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ নিতে জটিলতা ও অনীহা, একই পণ্যের ওপর বহু রকমের চাঁদা বা ট্যাক্স আদায়, পরিবহণ বা বাজার সুবিধা বিবেচনায় ক্রপ জোনিং না থাকা, কৃষক-ব্যবসায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবাদাতাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, মাল্টিস্টেকহোল্ডার পার্টনারশিপ না থাকা এবং বিভিন্ন কারণে প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানি পাহাড়ে বিনিয়োগ করতে অনীহা প্রকাশ করা ইত্যাদি টেকসই পাহাড়ি কৃষি উন্নয়নের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা।
বর্তমান সময়ে পাহাড়ি কৃষির সম্ভাবনার কথা বলতে গেলে প্রথমে আসবে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর, এগ্রো-প্রসেসিং, এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্ট ও ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ভ্যালু চেইন উন্নয়ন ও উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি। সম্ভাবনাময় ফসলের মধ্যে কাজুবাদাম ও কফি চাষ এবং এর প্রক্রিয়াজাত ও রফতানীকরণ উল্লেখযোগ্য। অধিক উৎপাদনক্ষম ফল যেমন- আম, কলা, কাঁঠাল, আনারস, পেঁপে, তরমুজ, জলপাই ইত্যাদি প্রক্রিয়াজাত করে ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য তৈরি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে আম পরিপক্ব হওয়ার প্রাক্কালে ঝড়ো হাওয়ায় প্রচুর কাঁচা আম ঝরে পড়ে। সেসব কাঁচা আম প্রক্রিয়াজাত করে গ্রিন ম্যাংগো জুস এবং বিভিন্ন ধরনের আচার তৈরি করে পর্যটকদের কাছে এবং স্থানীয়ভাবে বিক্রি করা যেতে পারে। এ ধরনের কাজ কমিউনিটি ভিত্তিক/হাউজহোল্ড বেজড করলে উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হবে। তবে বাণিজ্যিক আকারে করতে গেলে প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
পাহাড়ে পতিত জায়গায় পরিকল্পিতভাবে মিশ্র ফলদ বাগান সৃজন, ভ্যালিতে এবং পাহাড়ের উচ্চতা অনুসারে উচ্চমূল্য ফসলের চাষাবাদের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বারি আম-৩, বারি আম-৪, বারি আম-৮, বারি কলা-৩, বারি লিচু-২, বারি লিচু-৩, বারি মাল্টা-১, আনারস, পেঁপে, বারোমাসি কাঁঠাল, বারি পেয়ারা ও লেবুজাতীয় ফলের আবাদ বাড়নোর সুযোগ আছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য মসলাজাতীয় ফসল যেমন তেজপাতা, দারুচিনি, আলু বোখারা, এলাচসহ অনেক ফসল চাষে উৎসাহ জোগাতে হবে। অপ্রচলিত ফল সংগ্রহ করে মানোন্নয়নের ওপর গবেষণা করা যেতে পারে। জুমের স্থানীয় উন্নত জাতের ধান (ককরু, গ্যালন, শেরে), তিল, মারফা, রঙিন ভুট্টা, চিনাল, ছোট আকৃতির মিষ্টি কুমড়া, কাউন, জুম করলাসহ আরো নানা রকম স্থানীয় সবজি গবেষণার মেইন স্ট্রিমে নিয়ে এসে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ওপর গবেষণা প্রয়োজন। জুমের জন্য বিআর ২৬, ব্রি ধান-২৭, ব্র্রিধান-৪৮. ব্রি ধান-৫৫ সম্ভাবনাময়। পাহাড়ি পতিত ভূমিতে সেচ সুবিধা সৃষ্টি করে গ্রীষ্ককালে অমৌসুমি সবজি চাষ করার সুযোগ রয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় অবস্থিত কৃষি গবেষণা কেন্দ্রগুলোর অনেক প্রযুক্তি রয়েছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো মাঠ পর্যায়ে ছড়াতে গবেষণা সম্প্রসারণ লিংকেজ জোরদারকরণ অতীব জরুরি।
উচ্চফলনশীল ধানের আবাদ বাড়ানো, বছরব্যাপী সবজি উৎপাদন, হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ সম্প্রসারণ, ফল চাষের জোনিং করা, জুম চাষের লাভজনকতার জন্য উপযুক্ত ফসলের জাত বাছাইকরণ, পাহাড়ের উচ্চতা অনুযায়ী বিদেশি ফল এবং উচ্চমূল্য ফসলের ওপর উপযোগিতা যাচাই-পরীক্ষাকরণ ও আপ-স্কেলিংকরণ, পাহাড়ি জনপ্রিয় কৃষি পণ্য কাজুবাদাম, কফি, জুমের চিনাল, রুমার বা সাজেকের কমলা, বান্দরবানের পেঁপে বা আনারসসহ আরো অনেক ফলের ব্র্যান্ডিংকরণের মাধ্যমে রফতানির সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাবেক ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট এবং ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারি