নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা ও আন্দোলনের হুমকির মুখে বিচলিত নয় সরকার তথা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব গোটা বিশ্বের হিসাব নিকাশে পরিবর্তন এনেছে। অনেক দেশেই দাম বেড়েছে নিত্যপণ্যের। আমাদের দেশেই শুধুমাত্র জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে বিষয়টি এমন নয়।
তাছাড়া পণ্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে কার্যকর ব্যবস্থা। অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে বাজার পরিস্থিতি। তাই আন্দোলনের হুমকি দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের সুযোগ নেই বলছেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই। তারা মনে করেন, উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সাড়া দেবে না সাধারণ মানুষ। সেইসঙ্গে কোনো কোনো ষড়যন্ত্র কঠোর হাতে প্রতিহত করতে চায় সরকার। এজন্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শক্তিকে কাজে লাগাতে চায় আওয়ামী লীগ।
এদিকে বিরোধী দল বিএনপি প্রতিদিন নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে সরকারের সমালোচনা করছে। ইতোমধ্যে কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে দলটি। বসে নেই জাতীয় পার্টি। তারাও জনস্বার্থে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পালন করেছে। সরকারের সমালোচনায় মুখর অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও। ইতোমধ্যে বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে সারা দেশে অর্ধদিবস হরতাল পালন করা হয়েছে। আগামী দিনে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি আসতে পারে এমন ইঙ্গিত দিচ্ছেন অনেক দলের নেতা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপি জনগণের দল। জনগণ এখন সরকারের হাতে জিম্মি। তাদের উদ্ধারে পরিবর্তন আবশ্যক। ঈদের আগে-পরে ব্যাপার নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঐক্য নিয়ে আমরা জনগণের কাতারে দাঁড়াব।
সরকারের উন্নয়ন চোখে দেখতে পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। পক্ষান্তরে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিও দেখতে পাচ্ছেন বলে জানান তিনি। চুন্নু বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করছি যে আমরা দেখতে পাচ্ছি উন্নয়ন হচ্ছে অনেক। তবে আমরা দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির কারণে মানুষের হাহাকারও দেখতে পাচ্ছি। আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন নিত্যপণ্য আমাদের অনেক আছে। তারপরও জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। খাদ্যমন্ত্রীও বলেছেন এযাবৎকালের সর্বোচ্চ প্রায় ২০ লাখ টন খাদ্য গুদামে আছে। আমার প্রশ্ন তারপরও চালের দাম এত বাড়ল কী কারণে?
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা বা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো সাহস বা সুযোগ এই সরকারের নেই। কারণ এই দ্রব্যমূল্য যারা বৃদ্ধি করছে, তারা সিন্ডিকেট। তারা পকেট ভারী করার জন্য একসঙ্গে দ্রব্যের দাম বাড়াচ্ছে। তারা আওয়ামী লীগ। আজকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের জন্য হচ্ছে। খন্দকার মোশাররফ বলেন, আজকে সাধারণ মানুষের জীবন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দুর্বিষহ হয়ে গেছে। এখন টিসিবির ট্রাকের পিছে মধ্যবিত্তরাও লাইন দেয়। সারাদিন লাইন দিয়েও পণ্য পান না।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য যারা বলে সিন্ডিকেট সব করছে, তারা সরকারকে আড়াল করতে চায়। সবচেয়ে বড় সিন্ডিকেট এ সরকার। টিসিবির পণ্য বিক্রি প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, টিসিবির লাইনে প্যান্ট-শার্ট পরে মধ্যবিত্ত, সচ্ছল মানুষ পণ্য নিচ্ছে। উনার এ বক্তব্যের কিছুদিন পরই দেখলাম, চট্টগ্রামে টিসিবির পণ্যের ট্রাকের পেছনে শ দুয়েক মানুষ দৌড়াচ্ছে। এগুলো দুর্ভিক্ষের সিনেমার দৃশ্য হিসেবে দেখানো যায়। এ রকম করুণ দৃশ্য সবখানে।
এদিকে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে মানুষ পণ্য পায় না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে চরম দুর্বিষহ করে তুলেছে বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে গত সোমবার পল্টনে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ১ এপ্রিল মহাসমাবেশের ঘোষণাও দেন তিনি।
মুফতি ফয়জুল করীম বলেন, খেটে খাওয়া মানুষের কথা ভুলে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩১ মার্চ বৃহস্পতিবার অফিস আওয়ারের কথা বলা হলে আমরা তা বদলে শুক্রবার মহাসমাবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ নিয়ে টালবাহানা সহ্য করা হবে না।
সবার সমালোচনার প্রেক্ষিত্রে কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, কোনো শক্তিই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে না। কারণ, আওয়ামী লীগের ভিত্তি ও শেকড় এ দেশের মাটি ও মানুষের মাঝে। জনগণই বারবার আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করবে। মন্ত্রী বলেন, দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের কিছু লোক ও রাজাকার আলবদরসহ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে নানা রকম ষড়যন্ত্র করছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এদিকে চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রতিবাদে আগামী শনিবার রাজধানীতে গণঅনশন কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বুধবার যৌথসভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য লাগামহীন বৃদ্ধির প্রতিবাদে আগামী ২ এপ্রিল শনিবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আমরা অনশন করব।
দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে- প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এটা ওনারা নিয়মিত বলেন। কোন তারিখে সহনীয়? নিত্যপণ্যের এই ওনাদের কাছে সহনীয় হলেও দেশের সাধারণ মানুষের কাছে সহনীয় নয়।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে বিএনপি সারাদেশে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। বিএনপির কাজটাই হচ্ছে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানো। আপনারা দেখেছেন যখন পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হয় তখন বিএনপি বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল। ছেলেধরা গুজব ছড়িয়েছিল। এই পদ্মা সেতু করতে পারবে না বলে তারা নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল। আজকে পদ্মা সেতু হয়ে গেছে, উদ্বোধনের অপেক্ষায়।