logo
আপডেট : ৩১ মার্চ, ২০২২ ০৯:৪৩
বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক নুর মোহাম্মদ ভয়াবহ স্মৃতি বয়ে বেড়ান এখনো
কামরুল ইসলাম মাহি, সিলেট

বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক নুর মোহাম্মদ
ভয়াবহ স্মৃতি বয়ে বেড়ান এখনো

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক শাহ নুর মোহাম্মদ

‘আর যুদ্ধ চাই না। এই স্মৃতি মনেও করতে চাই না। কি ভয়াবহ দিন পার করেছি এখন মনে হলে গা আতকে উঠে। চারদিকে ধ্বংস আর হাহাকার’ কথাগুলো বলছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক শাহ নুর মোহাম্মদ।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সিলাম পশ্চিম পাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন নুর মোহাম্মদ। মৃত শাহ নাহার মোহাম্মদ ও অছিরা বিবি দম্পতির চার ছেলের বড় তিনি। চার ছেলে তিন মেয়ের জনক এ যোদ্ধার।

দৈনিক ভোরের আকাশের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে সিলেটের কৃতী সন্তান এই বিশ্বযোদ্ধা রোমহর্ষক দিনগুলোর কথা বর্ণনা করছেন।

বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি টেনে নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘তখনো যুদ্ধ চলছে। একবার ইউরোপিয়ান দেশগুলোর সৈনিকদের সঙ্গে অনেক উঁচু এক পাহাড়ে অভিযানে যাই। সেখানে তখন প্রচুর বরফ পড়েছিল। আমাদের পায়ে তখন গামবোট ছিল। বরফ আচ্ছাদিত অবস্থায় পা তখন প্রায় ডুব ডুব। ঠিক তখনই প আমরা চারজন জার্মান সৈনিকদের পেয়ে ঘেরাও করি। তাদের আমরা আটক করে গাড়ি করে ক্যাম্পে নিয়ে যাই।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি বেশ কিছু যায়গায় যুদ্ধের দায়িত্ব পালন করেছি তার মধ্যে ইতালির ট্রান্ট, বারী, বারলেতা রোম, নেপালের আগ্নেয়গিরি, মিলানে দায়িত্ব পালন করেছি। পারমাণবিক গ্যাস ছাড়ার ট্রেনিং ভালো করে জানি।’

মুখে রেস বোটার লাগাতে হয় বলে জানিয়ে তিনি বলেন, গ্যাস ছাড়ার মুহূর্তে অনেকের শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। এই কাজ আমি খুব ভালোভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। অনেক সময় অন্যান্য দেশের সৈনিকরা আমাকে ‘বাঙালি বাবু’ বলে ডাকত।’

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখেছিলাম সিলেটে। শেখ সাব শেখ সাব নামে স্লোগান দিয়েছিল সেদিন লোকজন।’

বিশ্বযুদ্ধের এ বীর সৈনিক ১৯৪২ সালে বৃটিশ রয়েল সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। পরের বছর ভারতের পাঞ্জাবের ফিরোজপুর ট্রেনিং একাডেমিতে ইনস্ট্রাকটর ও হাবিলদার পরে অনারারি ওয়ারেন্ট অফিসার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।

ওই বছরেই ট্রেনিং শেষে নুর মোহাম্মদ ইতালিতে বদলি করা হয়। সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন তিনি। জার্মানরা সে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করার পর ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন।

যুদ্ধ শেষে বৃটিশ সরকার নুর মোহাম্মদ আমেরিকা ও বৃটেনে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু অসুস্থ মায়ের সেবা করার জন্য অনুমতি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি। দেশে আসার সময় বৃটিশ সরকার তাকে আত্মকর্মসংস্থানের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে সম্মাননা সনদ প্রদান করে।

দেশে ফেরার পর নুর মোহাম্মদ ভারতের আসামে সরকারি ট্রান্সপোর্টে সহকারী স্টোর কিপার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর বৃটিশরা ভারত ছেড়ে দেয়ার পর ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির কার্যক্রম আসাম থেকে শিলংয়ে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করে ঢাকায় চলে আসেন তিনি।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে যোগদান করেন। পরে সেটেলমেন্ট বিভাগের বেঞ্চ সহকারী হিসেবে নতুন চাকরিতে যোগ দেন।

এরপর সিলেটের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রসেস সার্ভার ও পরে তাকে বিশ্বনাথে সার্কেল অফিসের কার্যালয়ে বদলি করা হয়। সেখান থেকেই তিনি অবসর নেন। অবসর নেয়ার পর তিনি সিলাম পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন।

নূর মোহাম্মদ বৃটিশ সেনাবাহিনীর সৈনিক হিসেবে ৩৯৪৫ ইতালি স্টার, ডিফেন্স মেডেল, ওয়ার মেডেলসহ বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন।