logo
আপডেট : ৩১ মার্চ, ২০২২ ১২:২২
দৈনন্দিন
শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট আসক্তি
নিজস্ব প্রতিবেদক

শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট আসক্তি

মোবাইল ও ইন্টারনেট আসক্তি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায়ই কেবল ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না, অনেককে অপরাধের দিকেও ধাবিত করছে

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সারাবিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে ইন্টারনেট এখন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও এখন মাদকদ্রব্যের প্রতি অতি মাত্রায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। একদিকে মাদক নেশা অপরদিকে নেট আসক্তি দেশের শিক্ষার্থীদের তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মাদক নেশাকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বন্ধ করার জন্য জোর চেষ্টা চললেও ইন্টারনেটকে বন্ধ করা তো দূরে থাক তার গতি আরো কিভাবে বাড়ানো যায় সেই চিন্তায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এখন ব্যস্ত। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটাই ইন্টারনেটনির্ভর। বিগত কয়েক বছর আগে আমাদের দেশে ইন্টারনেট সুবিধা থাকলেও এর ব্যবহার ছিল শিক্ষার্থীদের অনেকটাই বাইরে। তুলনামূলক কমসংখ্যক শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ব্যবহার করত বা নেট সম্পর্কে ধারণা ছিল খুবই কম। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর হাতে মোবাইলই ছিল না। সীমিত পরিসরে যাদের হাতে ছিল তাও আবার ছিল সাধারণ ডিভাইস- যা দিয়ে শুধু কথা বলা যেত। ইন্টারনেট ব্যবহারযোগ্য মোবাইল ছিল খুব কম। কিন্তু যখন মহামারি করোনা দেখা দিল অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে গেল। এ অবস্থায় সরকার শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস করার জন্য তাগিদ দিল। প্রত্যেক ছেলেমেয়ে অনলাইনে ক্লাস করতে হবে এই অজুহাত দেখিয়ে মা-বাবার ওপর চাপ প্রয়োগ করে এন্ড্রয়েড মোবাইল সেট ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে গেল- যার ব্যবহার তারা জানত না। আস্তে আস্তে বিভিন্নজনের কাছ থেকে ইন্টারনেটের ব্যবহার শিখে বর্তমানে অনলাইন ক্লাসের নামে পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে অনলাইন গেম ও নিষিদ্ধ কিংবা স্পর্শকাতর ওয়েবসাইটে দিনরাত ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। লেখাপড়ার নামে নেটে ঢুকে ক্ষতিকর সাইটে গিয়ে দৈনন্দিন কাজকর্ম ও পড়াশোনা ভুলে মাদক নেশার মতো বিভোর হয়ে পড়ে থাকে। মা-বাবা ডাকলে তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে।


স্কুল শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট কিংবা মোবাইল আসক্তি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। টিনএজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমস্যাটি বেশি প্রকট। দেখা যাচ্ছে, ক্লাস ফাইভ-সিক্স-সেভেনের অনেক শিক্ষার্থীর হাতে এখন দামি এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন! এরা প্রায় সব সময়ই অনলাইনে থাকে। এদের বেশিরভাগেরই দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। কারণ এরা গভীর রাত পর্যন্ত অনলাইনে সময় কাটায়। বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিং করে। স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, আমাদের শিশু-কিশোররা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে দিন দিন। এতে তাদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। অভিভাবকদের অবহেলা ও অসচেতনতা এবং শিশু-কিশোরদের জীবন দক্ষতার ঘাটতি থাকায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত ভয়াবহ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে।


নিম্নস্তরের শিক্ষার্থীরা যদি এভাবে মোবাইলে ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তারা ক্লাসে মনোযোগ দেবে কীভাবে? এমনিতেই স্কুল শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে। এসএসসি, এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার্থীর শিক্ষার মান বাড়ছে না। ২০০৮ সাল থেকে প্রবর্তিত সৃজনশীল পদ্ধতি সুযোগ্য শিক্ষকের অভাবে যথাযথভাবে কাজ না করায় শিক্ষার্থীদের কোচিং ও নোট-গাইডনির্ভরতা কমেনি। এসবের মধ্যেই মোবাইল ও ইন্টারনেট আসক্তি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায়ই কেবল ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না, অনেককে অপরাধের দিকেও ধাবিত করছে। ফলে স্কুলের একাডেমিক পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।


স্কুলে থাকাকালে শিক্ষার্থীরা যাতে ফেসবুক, ইউটিউব বা অনলাইন চ্যাটিং না করতে পারে সে বিষয়ে কিছু স্কুল সতর্ক পদক্ষেপ নিলেও মফস্বল শহর ও গ্রামীণ এলাকার স্কুলগুলো এ বিষয়ে উদাসীন। রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের কিছুসংখ্যক নামি-দামি স্কুলে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। শিক্ষার্থীরা জরুরি প্রয়োজনে বাবা-মাকে ফোন করতে চাইলে তাদের স্কুলের ফোন ব্যবহার করতে দেয়া হয়। এরপর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কোনো শিক্ষার্থী স্কুলে মোবাইল ফোন এনে ধরা পড়লে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে যদি এ সংক্রান্ত সুচিন্তিত নীতিমালা তৈরি করে তা সব স্কুলের জন্য মানা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়, তাহলে এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সুফল মিলতে পারে। শিক্ষার্থীদের পরিবারকেও এ বিষয়ে সতর্ক করা দরকার। এ ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষ যদি এক-দু’মাস পর পর অভিভাবকদের সঙ্গে সভা-মতবিনিময় করে তাদের এ বিষয়ে সতর্ক করত, তাহলে পারিবারিক পরিবেশেও শিক্ষার্থীদের মোবাইল ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার থেকে রক্ষা করা যেত। ফলে স্কুলের একাডেমিক পরিবেশেরও উন্নতি হতো।


স্কুল কর্তৃপক্ষ ও পরিবারের উচিত টিনএজ ছেলেমেয়েদের বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চায় উদ্বুদ্ধ করা। শিক্ষার্থীদের এক্সট্রা কারিকুলাম কার্যক্রমে উৎসাহিত করা। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায় উৎসাহ দেয়া। সর্বক্ষণ ঘরে থেকে ফোন বা ল্যাপটপে-অনলাইনে সময় ব্যয় করার বদলে বাইরের মুক্ত বাতাসে চলাফেরায় উদ্বুদ্ধ করা। ক্লাব, সভা-সমিতির কার্যক্রম ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ত করা। নিজ বন্ধুদের সঙ্গে ছাড়াও যাতে তারা সমাজে ছোট ও বড়দের সঙ্গে মিশতে পারে সে ব্যাপারে তাদের উৎসাহ দেয়া। আমরা এ কথা বলছি না যে, টিনএজদের ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেয়া যাবে না। অথবা তাদের মোবাইল ফোন দেয়া যাবে না। আমরা যেটা বলছি তা হলো, টিনএজ শিক্ষার্থীদের যেন ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন ব্যবহারের ভালোমন্দ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়। তারা যেন এসব আধুনিক প্রযুক্তির গঠনমূলক ব্যবহার করতে পারে। প্রযুক্তির অপরিকল্পিত ও অসতর্ক ব্যবহারের বিপদাপদ সম্পর্কে যেন তাদের ধারণা থাকে।


এমনিতেই দেশে উচ্চশিক্ষার মানের গতি নিম্নমুখী। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, তাদের সার্বিক মান ভালো নয়। আর ভালো হবেই বা কী করে! একে তো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব থাকায় ভালো শিক্ষকের দুর্ভিক্ষ চলছে; তার ওপর ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা আসছে, তারাও প্রত্যাশা অনুযায়ী মানসম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠছে না।
বিগত কয়েক বছর আগের একটা উদাহরণ দিলে এসএসসি ও এইচএসসি পাস শিক্ষার্থীদের মান সম্পর্কিত ধারণা আরো পরিষ্কার হবে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের শতকরা ৮০ ভাগ পরীক্ষার্থী পাস নম্বর পায়নি। এরা স্কুল থেকে বাংলা বা ইংরেজি ভাষার কোনোটিই ভালোভাবে শিখে আসতে পারছে না। কারণ ওই পরীক্ষায় বাংলা ও ইংরেজি পরীক্ষার ৩০ নম্বরের মধ্যে ৮ (পাস নম্বর)-এর কম নম্বর পেয়েছিল যথাক্রমে ৫৫ ও ৫৬ শতাংশ পরীক্ষার্থী। অবনতির নিম্নগতি অব্যাহত থাকায় এ বছর ঢাবির ‘গ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার্থীরা ফেলের রেকর্ড করেছে। এ পরীক্ষায় ১ হাজার ২৫০টি আসনের জন্য ৪২ হাজার ১২৪ জন আবেদনকারীর মধ্যে ভর্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছিল ৪০ হাজার ২৩৪ জন। এর মধ্যে ২ হাজার ২২১ জন পাস এবং ৩৮ হাজার ১০ জন ফেল করেছে। পাসের হার ৫.৫২ এবং ফেলের হার ৯৪.৪৮ শতাংশ। ভর্তি পরীক্ষার এমন ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়ার নিম্নমান প্রতিফলিত হয়েছে।


তবে শিক্ষার জন্য শুধু বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে চলবে না। একই সাথে অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। একজন ভালো মানের শিক্ষকের সবসময় তার ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া একান্ত কর্তব্য। সর্বোপরি, যেসব অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েদের হাতে অল্প বয়সে মোবাইল তুলে দেন তাদের এখন থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সুন্দর সামাজিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। শিক্ষার্থীদের সাথে সাথে এর সুফল পাব আমারা সবাই।


লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক