মুক্তিযুদ্ধের পর কেটেছে ৫১ বছর। মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা কিংবা যুদ্ধকালীন গণহত্যা, ধর্ষণ-নির্যাতন, বধ্যভূমিতে বর্বরতার প্রকৃত চিত্র নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে সময়ে সময়ে। পাক বাহিনীর নারকীয় বিভীষিকার সঠিক ও গ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যান বহু মন্তব্যের জন্ম দিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। শেষ পর্যন্ত দেশমুক্তির মহান যুদ্ধের উপর্যুক্ত বিষয়াবলি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামে হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর কর্তৃক সংঘটিত বর্বরোচিত ঘটনাসমূহের পূর্ণাঙ্গ তথ্য-উপাত্ত ও সঠিক পরিসংখ্যান জানতে পারব আমরা।
মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে বধ্যভূমিসহ গণহত্যার সংখ্যা ঠিক কতটি, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই এখন পর্যন্ত। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার জরিপ বলছে, দেশে পাঁচ হাজারের বেশি বধ্যভূমি রয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মাত্র ২৮১টি বধ্যভূমির তালিকা প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ‘১৯৭১ : গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘর’-এর পক্ষ থেকে দেশের ৩৪টি জেলার জরিপে গণহত্যা-বধ্যভূমি-গণকবর ও নির্যাতনকেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সংখ্যা আরো বাড়বে বলে বলা হচ্ছে। গণহত্যা চালানো হয়েছে এমন দুই হাজার নতুন স্থানের সন্ধান মিলেছে নতুন জরিপে। এসব স্থানের নাম আগে কোথাও পাওয়া যায়নি। নতুন যোগ হওয়া সংখ্যা মিলিয়ে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে শহিদের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি হবে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনা পাঁচ লাখের ওপরে। গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন করে সন্ধান করা ৩৪টি জেলায় গণহত্যা ১৪ হাজার ৪৫২টি, বধ্যভূমি ৭৫৯টি, গণকবর এক হাজার ৪৮টি এবং নির্যাতনকেন্দ্র এক হাজার ২৭টি। সার্বিক ফলাফলের প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে প্রতি বর্গমাইলে গণহত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এসব গণহত্যার প্রতিটির ওপর একটি করে বই প্রকাশের মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে গণহত্যা জাদুঘর। সময়োপযোগী এই উদ্যোগের ফলে মুক্তিযুদ্ধে শহিদের প্রকৃত ও সঠিক সংখ্যা নিয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকবে না। সব ধরনের বিতর্কেরও অবসান হবে নিঃসন্দেহে।
নতুন জরিপ ও গবেষণার সবচেয়ে বড় ফলাফল হলো, ৩৪টি জেলায় প্রায় ২০ হাজার গণহত্যার স্থানের সন্ধান মিলেছে- যেগুলোর কথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কেউই জানত না। ঠাকুরগাঁওয়ে ৫৩৮ জন শহিদের নাম পাওয়া গেছে, যাদের কথা কোনো বইতেও নেই।
নতুন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলো গণহত্যার ডিজিটাল মানচিত্র প্রণয়ন। মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর নির্মমতার সাক্ষী গণহত্যার স্থান, বধ্যভূমি, গণকবর, নির্যাতনকেন্দ্র ও স্মৃতিফলক চিহ্নিত করে ডিজিটাল ম্যাপ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’। গণহত্যার স্মৃতিচিহ্ন চিহ্নিত করে ডিজিটাল ম্যাপ প্রকাশের এমন উদ্যোগ বিশ্বে এটাই প্রথম। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এ রকম ম্যাপ নেই। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি জেলায় গণহত্যার স্মৃতিচিহ্ন ও তথ্য ডিজিটাল ম্যাপে প্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
একাত্তরে বাংলাদেশে যে নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি আজো। এই স্বীকৃতি না পাওয়ার পেছনে আন্তর্জাতিক রাজনীতি রয়েছে সত্য, তবে আমাদেরও দুর্বলতা রয়েছে বেশ। আমরা গণহত্যার দলিলপত্র আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রচার করতে পারিনি। দেশের মানুষও নিজের এলাকার গণহত্যার পর্যাপ্ত তথ্য জানে না। কাজেই উপরোল্লিখিত উদ্যোগ গ্রহণের ফলে এবার আন্তর্জাতিক পরিসরে একাত্তরের গণহত্যার চিত্র প্রকাশ পাবে। গণহত্যার স্বীকৃতি লাভের পথ প্রশস্ত হবে। দেশ ও জাতি দায়মুক্ত হবে।