মায়ের হাতে স্যালাইন লাগানো। রুটি হাতে নিয়ে মাথার পাশে বসে আছে ছোট্ট শিশুটি। বাসায় রেখে আসার মতোও কেউ নেই। তাই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত মা সুফিয়া ছোট্ট সন্তান নুর আলমকে নিয়েই এসেছেন হাসপাতালে। এতটুকু শিশু কী আর সাহায্য করতে পারে মায়ের। এই অসুস্থ শরীরেও কলেরা হাসপাতাল হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পাওয়া আইসিডিডিআর,বিতে এসেও শয্যা মেলেনি হাসপাতালের ভেতরে। তার চিকিৎসা চলছে তাঁবুতে। এমন অসুস্থ শরীরেও বাধ্য হয়ে সুফিয়া নিজেই দেখভাল করছেন ছেলের।
সুফিয়া পেশায় গৃহশ্রমিক। স্বামী নেই। দুই সন্তান নিয়ে বাড্ডা থাকেন। বড় ছেলে গার্মেন্টেসে চাকরি করে। ছেলেও নাকি জানে না তার মা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
মহাখালী আইসিডিডিআর,বির কলেরা হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা এতই বেড়েছে যে শয্যা খালি না থাকায় হাসপাতালের সামনের প্রাঙ্গণে দুইটি তাঁবু খাটিয়ে এসব রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতাল গেট দিয়ে ঢুকে প্রথম যে তাঁবু খাটানো হয়েছে রোগীদের জন্য সেখানেই চিকিৎসা চলছে সুফিয়ার। এই তাঁবুতে তার মতো আরো অন্তত একশ’রোগী রয়েছেন।
হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্রটির গেটের ভেতরে ঢুকেই আঁতকে উঠতে হল। রোগীর যেন বিরাম নেই। মূহুর্মূহু হুইল চেয়ারে করে কাউকে না কাউকে ঠেলে নিয়ে আসছেন তার স্বজনরা।
কেউ স্ত্রীকে নিয়ে, কেউ মাকে নিয়ে, কেউ বা সন্তানকে নিয়ে, কেউ ভাই বা প্রতিবেশীকে নিয়ে আসছেন। হাসপাতালের গেট পর্যন্ত সিএনজি, রিকশায় রোগী নিয়ে আসার পর ভেতরে যারা হেঁটে যেতে পারেন তারা হেঁটেই ঢুকছেন, আর যারা হাঁটতেই পারছেন না স্বজনরা তাদের টেনে আনছেন হুইল চেয়ারে।
বৃহস্পতিবার সকাল ১১ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত সেখানে দাঁড়িয়ে দেখা গেছে, ৯৫ জন রোগী এসেছেন এই এক ঘণ্টায়। এরপর বেলা ১২ টা থেকে ১ টা পর্যন্ত আসেন ৭৯ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী। এভাবে এদিন দুপুর ১ টা পর্যন্ত ভর্তি হতে এসেছেন ৬৪৫ জন রোগী।
রোগী বেশি যাত্রাবাড়ি, জুরাইন, শনিরআখড়ার বেশি আক্রান্ত নিম্ন আয়ের মানুষ ৩০ শতাংশের কলেরা নতুন তাঁবু স্থাপনের প্রস্তুতি
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশি রোগী আসছে যাত্রাবাড়ি, জুরাইন, শনির আখড়া এলাকা থেকে। এছাড়া উত্তরা-মীরপুর থেকেও রোগী আসছে। যারা আসছেন তাদের বেশির ভাগই নিম্নআয়ের দিনমজুর মানুষ; রিকশা চালক, নির্মাণ শ্রমিক, মটর শ্রমিক, গৃহকর্মী।
উত্তরা থেকে আসা মনির হোসেন (২১) জানান, তিনি ফিলটারের পানি পান করেন। কেন এমন হল বুঝতে পারছেন না। বুধবার রাত থেকে তার বমি। আর টয়লেট একবারেই পানির মতো।
ভাটারা সাইদনগর থেকে আসা অমল বলেন, তাদের এলাকায় পানির সমস্যা রয়েছে। দূষিত পানির কারণে তার ডায়রিয়া হতে পারে বলে ধারণা।
মিরপুরের মণিপুরী পাড়া এলাকা থেকে স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন মইনুদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘কেন এমন হল বুঝতে পারছি না। আমরা খাবারের বিষয়ে খুবই সচেতন। বাইরের খাবার খাই না। পানিতেও সমস্যা নেই।’ তিনি ধারণা করছেন, গরমের কারণে হয়তো এমন হতে পারে।
টিকাটুলি থেকে ভর্তি হয়েছেন ভ্যান চালক রহিম। সঙ্গে রয়েছে তার স্ত্রী ও ছোট শিশু সন্তান।
রহিম জানান, তিনি তিনদিন ধরে আক্রান্ত। সন্ধ্যা বাইরে সিঙ্গারা খেয়ে ফিলটার পানি খেয়েছিলেন। পরদিন সকাল থেকেই সামান্য পেটে ব্যথা এবং টয়লেট শুরু হয়। নিয়ন্ত্রণে না আসায় বৃহস্পতিবার তিনি হাসপাতালে আসেন।
আইসিডিডিআর,বি সূত্রে জানা গেছে, গেলো কয়েকদিন ধরে রোগী রাড়তে থাকায় হাসপাতালে বাইরে দুটি তাঁবু করে তাতে ডায়রিয়ার রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে ৩৫০ শয্যা রয়েছে। দুটি তাঁবুর একটিতে ৮০ এবং আরেকটিকে ৪৫ জনের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রোগীর চাপ বাড়তে থাকলে আরেকটি তাঁবু স্থাপনেরও প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানা গেছে।
এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর এ বছরই এই প্রথম এত রোগী ভর্তি হয়েছে বলে জানান সিনিয়র ফিজিশিয়ান ডা. এসএম রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতিদিন এত বেশি রোগী আগে কখনো আমরা পাইনি। দিনে এগারোশর বেশি রোগী আমরা আগে পাইনি। এবারই প্রথম প্রতিদিন তেরশর বেশি রোগী পাচ্ছি। সেই হিসেবে আমরা বলি এটা সার্বিকভাবে একটা উদ্বেগের বিষয়।
এই চিকিৎসক আরো বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান এটা মোকাবিলায় সক্ষম।
ভর্তি রোগীদের মধ্যে কলেরায় আক্রান্তের হার ৩০ শতাংশের মতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা কলেরা এন্ডেমিক জোন। যখনই অতিরিক্ত ডায়রিয়া হবে, তখনই মাথায় আসবে কলেরা হয়ে যাওয়ার পসিবিলিটি বেশি, সেটাই হচ্ছে।
ডা. এসএম রফিকুল ইসলাম বলেন, কেন এতো আক্রান্ত হচ্ছে, তা নিয়ে এখনই নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে কয়েকটা রিস্ক ফ্যাক্টর থাকতে পারে। ব্যাপক ভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও হতে পারে। আগাম গরম দেখা যাচ্ছে। ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে।
তীব্র পানিশূন্যতা নিয়েই অধিকাংশ রোগী আসছে বলে জানান তিনি। বলেন, ৪০ শতাংশ রোগী তীব্র পানিশূন্যতা নিয়ে আসছে। তীব্রমাত্রার যেসকল রোগী আসছে, অধিকাংশই শ্রমিক শ্রেণির। তাই আমরা এটা অনুমান করতে পারি, যেহেতু এরা ঘরের বাইরে থাকেন, যেখানে কাজ করেন সেখানকার খাবারই খান।
যারা ভর্তি হয়েছেন- তাদের অনেকের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনেছি তারা অনেকই বাইরের পানি পান করেন। রাস্তায় অনেক পানি বিক্রি হয়। দেখতে সুন্দর চকচকে। কিন্তু তাতে জীবাণু থাকতে পারে। রাস্তাঘাটের যেসব দূষিত পানি তারা পান করছেন, ফুটপাতের খোলা খাবার তারা খান তা থেকেও আক্রান্ত হতে পারেন।
দূষিত পানি ও খোলা ও পচা বাসি খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন তিনি।
ডা. এসএম রফিকুল ইসলাম বলেন, যারা বিশুদ্ধ পানি কিনে খেতে না পারেন তারা আধাঘণ্টা ধরে বলক তুলে পানি ফুটাবেন, ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে এরপর সেই পানি পান করবেন। বাসায় বাইরে যখন যাবেন, তারা যেন বাসা বোতলে করে এই ফুটানো পানি নিয়ে যান।
আইসিডিডিআর-বি’র মিডিয়া ম্যানেজার একেএম তারিফুল ইসলাম খান বলেন, ঢাকারও সব জায়গা থেকে রোগী আসছে না, কিছু কিছু এলাকা থেকেই রোগী আসছে। সেসব জায়গায় পানির সমস্যার কারণে তারা আক্রান্ত হচ্ছেন।
পানি ফুটিয়ে খাওয়ার বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডায়রিয়া পানিবাহিত রোগ। তবে পানি ছাড়া খাবার থেকেও আক্রান্ত হতে পারে। যেসব জায়গায় পানির সমস্যা নেই সেসব এলাকায় মানুষ অস্বাস্থ্যকর খাবারের কারণে আক্রান্ত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, মানুষ মনে করে খাবারে দুর্গন্ধ হলে খাবার নষ্ট হয়। সবসময় তা কিন্তু নয়। দুর্গন্ধ হওয়ার আগেও খাবার খাওয়ার অনুপোযোগী হতে পারে। গরমের কারণে খাবার দ্রুত নষ্ট হয়। খাবারে গন্ধ হওয়ার আগে নষ্ট হওয়া শুরু হয়। সেই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
আইসিডিডিআরবি থেকে জানা গেছে-১৬ মার্চ ১ হাজার ৫৭ জন, ১৭ মার্চ ১ হাজার ১৪১ জন, ১৮ মার্চ ১ হাজার ১৭৪ জন, ১৯ মার্চ ১ হাজার ১৩৫ জন, ২০ মার্চ ১ হাজার ১৫৭ জন, ২১ মার্চ ১ হাজার ২১৬ জন, ২২ মার্চ ১ হাজার ২৭২ জন, ২৩ মার্চ ১ হাজার ২৩৩ জন, ২৪ মার্চ ১ হাজার ১৭৬ জন, ২৫ মার্চ ১ হাজার ১৩৮ জন, ২৬ মার্চ ১ হাজার ২৪৫ জন, ২৭ মার্চ ১ হাজার ২৩০ জন এবং ২৮ মার্চ ১ হাজার ৩৩৪ জন, ২৯ মার্চ ১ হাজার ৩১৭ জন, ৩০ মার্চ ১ হাজার ৩৩১ জন ভর্তি হয়। ৩১ মার্চ বেলা ১ টা পর্যন্ত ভর্তি হয় ৬৪৫ জন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, এত ডায়রিয়া সংক্রমণের তিনটা কারণ থাকতে পারে। প্রথমত অনিরাপদ পানি, দ্বিতীয়ত, বায়ুদুষণের কারণে জীবাণুযুক্ত ধূলিকণা খোলা খাবারে পড়া এবং আরেকটা হচ্ছে যারা করোনা আক্রান্ত হয়েছেন- তাদের পেটের পীড়া দেখা দেয়।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আমাদের ধারণা প্রথম দুটির কারণে বাড়ছে। তাই সবাইকে নিরাপদ পানি পান করতে হবে। ওয়াসা আমাদের যে দূষিত পানি সরবরাহ করে আসছে এ থেকে পরিত্রাণ দিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। আর কলকারখানা বর্জ্য জলাশয়ে ফেলা বন্ধ করতে হবে।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, পানি বড় সমস্যা। আরেকটা সমস্যা খাবার পরিবেশন। যে পাত্রে, যে কাগজে খাবার পরিবেশন করছে তাতে ব্যাকটেরিয়া থাকছে। বাইরে না খেয়ে তো সাধারণ মানুষের উপায় নেই। ফুটপাতের খাবার তাকে খেতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, খাবারের দোকান বন্ধ করে দেওয়াও সমাধান নয়। যাতে ফ্রেস প্যাকেট বা পাত্রে সরবরাহ করা যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। চাইলে সিটি কর্পোরেশন ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে।