logo
আপডেট : ১ এপ্রিল, ২০২২ ০৯:৪৬
দখল-দূষণে মৃতপ্রায় লৌহজং 
জুয়েল রানা, টাঙ্গাইল

দখল-দূষণে মৃতপ্রায় লৌহজং 

টাঙ্গাইল জেলা শহরের মৃতপ্রায় লৌহজং নদী

এক কালের খরস্রোতা লৌহজং নদী এখন মৃতপ্রায়। পলি জমার পাশাপাশি পানির অভাবে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও নাব্য হারিয়ে গেছে। এমন বৈরী পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবৈধ দখল ও শহরের বর্জের স্তূপ। দূষণ বর্তমানে এই নদীটিকে মরা নোংরা খালে পরিণত করেছে।

এসবই ঘটেছে মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাশিনগর এলাকায় ধলেশ্বরী থেকে উৎপত্তি হয়ে ৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ লৌহজং নদী জেলা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জেলার মির্জাপুর উপজেলার বংশাই নদীতে গিয়ে পড়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, লৌহজং নদীর উৎসমুখ বালিতে ভরাট হয়ে গেছে। যুগনী স্লুইস গেট এলাকাসহ নদীর অধিকাংশ স্থানই প্রায় পানিশূন্য। শহর এলাকায় নর্দমার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে নদীটি। দিনের পর দিন ফেলা নোংরা আবর্জনার গন্ধে টেকা দুষ্কর হয়ে পড়েছে নদীপারের বাসিন্দাদের।

শহরের বেশ কয়েকজন প্রবীণ জানান, টাঙ্গাইল শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে এই নদী। ১৯৮০ দশক পর্যন্ত এই নদীতে লঞ্চ ও পণ্যবোঝাই বড় বড় নৌকা চলাচল করেছে। এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ক্ষেত্রে লৌহজং নদীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে খুব সহজে এ নদীর মাধ্যমে টাঙ্গাইল জেলা শহরে প্রবেশ করা যেত। ফলে যাত্রী পরিবহণ এবং মালামাল স্থানান্তরে আরামদায়ক পথ ছিল এ নদী। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে নদীর ভূমিকা অস্বীকার্য ছিল।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা কর্ম পরিকল্পনার (ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান/ফ্যাপ-২০) অধীনে ১৯৯১ সালে সদর উপজেলার যুগনীতে লৌহজং ও ধলেশ্বরীর সঙ্গমস্থলের কাছে স্লুইস গেট নির্মাণ করায় মরে যেতে শুরু করে নদীটি। আর নদীর তীর দ্রুত দখল হয়ে যেতে শুরু করে। চলছে বাড়ি-ঘর নির্মাণ, ধান ও সবজি চাষ।

এর পাশাপাশি পৌর এলাকার বসতবাড়ি ও বিসিক শিল্প এলাকার কয়েকটি কারখানা থেকে নির্গত ময়লা পানি ও আবর্জনা, বর্জ নদীটিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করেছে। লৌহজংয়ের পানি মানুষ ও গবাদিপশুর ব্যবহারে অনুপযোগী হয়ে পরে। এই নদীতে থাকা জলজ প্রাণী বিলুপ্তির মুখে পড়ে। তাছাড়া, দূষিত পানির দুর্গন্ধে নদীর ধারে মানুষের বসবাস কঠিন হয়ে পড়ে।

এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে বছরের পর বছর ধরে সংশ্লিষ্ট নাগরিক ও স্থানীয় পরিবেশ কর্মীরা নদীটির নাব্য ফিরিয়ে আনাসহ দখল ও দূষণমুক্ত করার দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন।

২০১৬ সালের ২৯ নভেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসন মোট ৭৬ কিলোমিটার নদীর মধ্যে পৌর এলাকার হাজরা ঘাট থেকে বেড়াডোমা পর্যন্ত মাত্র দেড় কিলোমিটার এলাকার নদীর জায়গা দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। প্রাথমিকভাবে কিছু অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করা হলেও পরে অজ্ঞাত কারণে উচ্ছেদ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন জেলা প্রশাসন একই স্থানে পুনরায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে।

সে সময় শুধু সদর উপজেলাতেই সাড়ে চার শতাধিক অবৈধ স্থাপনা শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে পৌর এলাকায় নদীর তীরে তিন কিলোমিটারের মধ্যে ২৬০টির বেশি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। কয়েকটি স্থাপনা ভেঙে ফেলার পর, নদীর সীমানা নির্ধারণ ও দখলদারদের চিহ্নিত করা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়ে এই অভিযানটিও স্থগিত করা হয়।

পৌর এলাকার স্টেডিয়াম সংলগ্ন নদীপাড়ের বাসিন্দা মজিবুর রহমান বলেন, ‘সরকার নদীটি খনন করতে চাচ্ছে। পরিবেশ সুন্দর করতে চাচ্ছে, এর সঙ্গে আমরা একমত। কথা হলো, ১৯৬২ সালে জমিগুলো আমাদের নামে রেকর্ড করে দেওয়ায় ডিসি অফিস খারিজ দিয়েছে। ভূমি অফিস খাজনা নিয়েছে ও পৌরসভা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনার অনুমোদন করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ঘর করেছি।’

‘এখন যদি এই জমি থেকে আমাদের সরিয়ে দেওয়া হয় তবে আমাদের জমির ন্যায্যমূল্য দিতে হবে,’ যোগ করেন তিনি।

টাঙ্গাইলের নদী, খাল ও জলাশয় রক্ষা আন্দোলন কমিটির সাধারণ সম্পাদক রতন আহমেদ সিদ্দিক বলেন, ‘নদীর জমি দখলের পাশাপাশি সেখানে এখনো আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। শহরের প্রধান কাঁচাবাজার পার্ক বাজারের সব বর্জ ড্রেনের মাধ্যমে নদীতে ফেলা হচ্ছে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) টাঙ্গাইলের বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র বলেন, ‘দখল-দূষণে লৌহজং মৃতপ্রায় আজ। শুধু দেড় বা তিন কিলোমিটার উদ্ধার করে নদীর পাড়ে রাস্তা বা অন্য কিছু নির্মাণ করে কাজের কাজ কিছু হবে না। মানুষ নদী সৃষ্টি করতে পারে না। এটি প্রাকৃতিক সম্পদ। নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, দেশ বাঁচবে। কাজেই নদীটিকে সচল করতে হবে।’

নদীর উৎস মুখ থেকে প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘নদীকে নদীর গতিতে চলতে দিতে হবে। এর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে।’

সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘নদীটির বেহাল দশা দেখেছি। যে অংশটুকুতে অভিযান চালানো হয়েছিল তা আবার দখলের প্রক্রিয়া চলছে।’

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. মো. আতাউল গণি বলেন, ‘এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আবারো অভিযান চলবে নদী পুনরুদ্ধার হবে।’