logo
আপডেট : ১ এপ্রিল, ২০২২ ১০:৩২
পেঁয়াজের বীজ বেচে কোটিপতি শাহিদা
সঞ্জিব দাস, ফরিদপুর

পেঁয়াজের বীজ বেচে কোটিপতি শাহিদা

পেঁয়াজের বীজ বেচে কোটিপতি চাষি শাহিদা

প্রায় ২০ বছর ধরে চাষ করছেন পেঁয়াজ বীজ। পেঁয়াজ ও পেঁয়াজ বীজ চাষ করে পেয়েছেন বহু পুরস্কার। কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনকারী কৃষকদের তালিকায় তার নামটা জ্বল জ্বল করছে। হয়েছেন দেশের সেরা নারী কৃষক। বীজ বিক্রি করে আয় করেছেন কোটি কোটি টাকা।

বলছি ফরিদপুরের পেঁয়াজ বীজ চাষি শাহিদা বেগমের কথা। জেলা সদর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামে তার বাড়ি। শাহিদা বেগম পেঁয়াজের বীজ চাষ করে শুধু আত্মনির্ভরশীল নয় বরং অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন।

একজন পুরোদস্তুর কৃষক সাহিদা বেগম। অনেকে অবশ্য বলেন সফল কৃষক। গত বছর আবহাওয়া অনূকুলে না থাকার পরও তার পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল প্রায় ১ কোটি টাকার মতো। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করে ছিলেন ৪ কোটি টাকার। চলতি বছরে পেঁয়াজ বীজ চাষ করেছেন ৩০ একর জমিতে। প্রায় ২০০ মণ পেঁয়াজের বীজ হবে এই তার লক্ষ্য।

দেশের মোট চাহিদার পেঁয়াজ বীজের চার ভাগের এক ভাগ আসে শাহিদার উৎপাদিত ‘খান বীজ’ থেকে। গত কয়েক বছর তার চাষ করা পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করে তিনি লাভ করেছেন কয়েক কোটি টাকা।

গত মঙ্গলবার বিকেলে শাহেদা বেগমের পেঁয়াজের মাঠ পরিদর্শনে আসেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সিটিউটের মহাপরিচালক ড. দেবাশিষ সরকারসহ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল।

এ সময় ড. দেবাশিষ সরকার শাহিদার প্রশংসা করে বলেন, ‘নারী উদ্যোক্তা শাহিদা বেগমের কৃষি খামার একটি মডেল। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রবর্তিত কৃষি প্রণোদনার ওপর ভর করে এ ধরনের লাখ লাখ শাহিদার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে আজকের বাংলাদেশ।’

তিনি আরো বলেন, ‘সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করার পরিবর্তে পেঁয়াজ রপ্তানি করতে শুরু করবে। পেঁয়াজ উৎপাদনেও স্বনির্ভর হবে প্রিয় স্বদেশ। শাহিদা বেগমের পেঁয়াজ বীজ সারা দেশের পেঁয়াজ চাষে যে ভূমিকা রাখছে তা একটি জেলার জন্য গর্বের।’

দেশসেরা নারী চাষি শাহিদা বেগম জানান, কৃষক পরিবারের বউ হওয়ার কারণে আগে থেকেই কৃষিকাজের সঙ্গে পরিচয় ছিল তার। শাহেদার শ্বশুর মূলত পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু কখনোই বেশি পরিসরে চাষ করেননি তিনি।

২০০৪ সালে দ্বিতীয় সন্তান জন্মের আগে ২০ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজের বীজ চাষ করেন শাহিদা। সে বছর মাত্র দুই মণ বীজ উৎপাদন হয়েছিল তার ক্ষেতে। সেগুলো বিক্রি করে পেয়েছিলেন ৮০ হাজার টাকা। পরের বছর আরো বেশি পরিমাণ জমিতে পেঁয়াজের চাষ করেন। সে বছর পেয়েছিলেন ১৩ মণ বীজ।

বীজ বিক্রি করে ভালোই লাভবান হচ্ছিল শাহিদা। এর জেরে পরের বছর আরো জমি বাড়ান। ৩২ মণ বীজ উঠল সেবার। এভাবেই তিনি সফল চাষি হয়ে উঠেন।

শাহিদা বলেন, ‘আমি নিজেও অনেকটা শখের বশেই পেঁয়াজ চাষ শুরু করি। আশপাশের কেউ কেউ খুব কম করে পেঁয়াজের বীজ চাষ করতো। আমারো মনে হলো আমি করে দেখি, তাই করলাম।’

তিনি আরো বলেন, ‘এ বছর ৩০ একর জমিতে পেঁয়াজের বীজের চাষ করেছি। অনেক শ্রম দিতে হয়। কষ্ট করতে হয়। পেঁয়াজের বীজের জন্য অনেক যত্ন করতে হয়।’

জেলার স্থানীয় কৃষক তো বটেই, পুরো বাংলাদেশে তারা বীজ সরবরাহ করে থাকেন তিনি। শাহেদা বলেন, ‘আমাদের বীজ ভালো বলে চাহিদা থাকে। কৃষকরা অনেক খুশি। কারণ এর মধ্যে কোনো ঝামেলা নাই।’

শাহিদা বেগমের পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের কাজে সহায়তা করেন তার স্বামী বক্তার উদ্দিন খানও। তিনি চাকরি করেন সোনালী ব্যাংকে। সাহিদা বেগম নিজেই গড়ে তুলেছেন পেঁয়াজের বীজের কারখানা। সেখান থেকেই বীজ প্যাকেটজাত করা এবং ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করা হয়। তার উৎপাদিত বীজ ক্রেতাদের কাছে পরিচিত ‘খান বীজ’ নামে।

শাহেদা বেগমের উৎপাদিত পেঁয়াজ বীজ হলো তাহেরপুরী, সুখ সাগর, নাসিক কিং, বারী-১, বারী-৪, বারী-৫ ও গ্রীষ্ম কালিন পেঁয়াজ বীজ।

স্থানীয় কৃষক আলমাস শেখ বলেন, ‘আমরা আগে অন্য ফসল চাষ করতাম। এখন পেঁয়াজ বীজ চাষ করি। শাহেদা বেগম যেভাবে এলাকায় পেঁয়াজ চাষ করছেন সেটা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েই আমাদের এই চাষে আসা। এখন ভালো লাভ পাচ্ছি। দিনকে দিন আমারও চাষের এলাকা বাড়ছে।’

আরেক কৃষক আপন বলেন, ‘শাহেদা বেগম শুধু পরিবর্তন করেননি। পেঁয়াজ চাষে তার সফলতা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমরা তার দেখাদেখি এখন অধিক পরিমাণ জমিতে পেঁয়াজ ও এর বীজের চাষ শুরু করেছি। আগে ছিল টিনের ঘর এখন আমার বাড়িতে বিল্ডিং হয়েছে। এভাবে যদি পেঁয়াজ বীজের চাষ করতে পারি তাহলে সামনের দিনে দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি থাকবে না।’

ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. হজরত আলী বলেন, ‘সত্যি বলছি পেঁয়াজ ও পেঁয়াজ বীজের চাষে শাহেদা বেগম একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তার পেঁয়াজ ও বীজের কারণে সামনের দিনে দেশে পেঁয়াজের যে ঘাটতি রয়েছে তা আর থাকবে না। তার বীজের মান অনেক ভালো। ’