পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির খাদ্য খাতের জিল বাংলা সুগার। আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় কোম্পানির অবস্থা নাজুক। দিন যত যাচ্ছে ততই এর অবস্থা আরো করুণ হচ্ছে। বাড়ছে দায়দেনার পরিমাণ। বর্তমানে কোম্পানির মোট দায়দেনার পরিমাণ ২৭২ কোটি টাকা। কোম্পানির অস্তিত্ব টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। টানা ৩২ বছর এখান থেকে লভ্যাংশ পাননি শেয়ারওহোল্ডাররা। কিন্তু তারপরও বছরের বেশির ভাগ সময় অস্বাভাবিক হারে বাড়তে দেখা যায় এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর। কারসাজি চক্রের ইন্ধনে এমন হচ্ছে বলে মনে করছেন সবাই।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, জিল বাংলা সুগার ১৯৮৮ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। পুঁজিবাজারে এসেই লোকসানের মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শেয়ারহোল্ডাররা সর্বশেষ লভ্যাংশ পান ১৯৯০ সালে। এ বছর কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের ২০ শতাংশ লভ্যাংশ প্রদান করে। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯১ সালে শেয়ারহোল্ডারদের হতাশ করে নো-ডিভিডেন্ট ঘোষণা করে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডাররা লভ্যাংশের দেখা পাননি। প্রতিবারই শেয়ারহোল্ডারা আশায় থেকেছেন পরের বছর লভ্যাংশ পাবেন। এভাবে কেটে গেছে ৩২ বছর। শেয়ারহোল্ডাররা লভ্যাংশের দেখা পাননি। কিন্তু তারপরও বছরের বেশির ভাগ সময় এ কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে।
কোম্পানি সূত্র জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি থেকে শেয়ারহোল্ডাররা কোনো ধরনের রিটার্ন না পাওয়ার প্রধান কারণ পুঞ্জীভূত লোকসান। তথ্যমতে, দুই বছর আগে জিল বাংলা সুগারের লোকসানের পরিমাণ ছিল ২৩৭ কোটি টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ২৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ২৬৫ কোটি এবং স্বল্প মেয়াদি ঋণ প্রায় সাত কোটি টাকা।
এদিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে থাকার পাশাপাশি আর্থিক অবস্থা নাজুক থাকার পরও শেয়ারের দর বৃদ্ধির দৌরাত্ম্যে বিস্মিত অনেকেই। যদিও এখন কিছুটা নিম্নমুখী রয়েছে এর শেয়ারদর। তবে এই দরে শেয়ার অতি মূল্যায়িত হয়ে রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কারো কারো মতে, আর্থিক অবস্থা দুর্বল এসব কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির পেছনে কারসাজি রয়েছে। তা না হলে কোনোভাবেই এসব শেয়ারের দর এমনভাবে বাড়তে পারে না।
এ প্রসঙ্গে জুয়েল হোসেন নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘যেখানে ভালো মানের কোম্পানির শেয়ারের দর বছরের পর বছর বাড়ছে না, সেখানে এ কোম্পানির শেয়ারদর যেভাবে বাড়ে তা সন্দেহজনক। কারসাজি ছাড়া এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।’
বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকলে ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। বিষয়টি বিনিয়োগকারীদেরই মাথায় রাখা দরকার। কারণ এ ধরনের কোম্পানিতে মুনাফার চেয়ে ক্ষতির শঙ্কাই বেশি থাকে। কথা হচ্ছে যার পুঁজি, উনি যদি বিনিয়োগে ভুল করেন তাহলে করার কিছু নেই।
এদিকে জিল বাংলা সুগার লোকসান থেকে বের হতে এবং সক্ষমতার সঙ্গে পরিচালিত হতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। সম্প্রতি সরকারি এই কোম্পানিটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর তদন্ত করে বিষয়টি জানতে পেরেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সরকারের সাহায্য ছাড়া কোম্পানিটি চলার মতো অবস্থা নেই। বিগত কয়েক বছর ধরে কোম্পানিটি মুনাফার মুখ দেখেনি। কোম্পানিটি পণ্য বানানোর জন্য যে খরচ হয় সেটিও উঠাতে পারেনি। এমতাবস্থায় বিএসইসি কোম্পানির ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, কোম্পানিটির দেনার পরিমাণ সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি। ২০২১ সালে কোম্পানিটির দায় মালিকানাস্বত্ব অনুপাত ছিল মাইনাস ১ দশমিক ৩৫। ২০২০ সালে যার পরিমাণ ছিল মাইনাস ১ দশমিক ১৮। যদিও ২০১৯ সালে পজিটিভ ছিল। দায় মালিকানা স্বত্ব অনুপাত ছিল ১ দশমিক ১৪ শতাংশ।
খাদ্য ও আনুষাঙ্গিক খাতের এই কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার সংখ্যা ৫১ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের পরিমাণ ১৩ দশমিক ০৩ শতাংশ। সাধারণ বিনিয়োগকারীর শেয়ার সংখ্যা ৩৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
জানতে চাইলে শ্যামপুর সুগারের এক সদ্য সাবেক সচিব ও বর্তমানে হিসাব বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা আব্দুল গফুর মিয়া ভোরের আকাশকে বলেন, ‘কোম্পানি বছরের পর বছর লোকসানে থাকার কারণে আমরা ইচ্ছে থাকলেও শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারি না।’
লোকসান সত্ত্বেও শেয়ারের দরবৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা বিনিয়োগকারীদের বিষয়। তাদের আগ্রহ থাকলে শেয়ারের দর বাড়ে, আবার আগ্রহ না থাকলে শেয়ারের দর কমে যাবে। এটা খুবই স্বাভাবিক। ফলে কেন দর বাড়ছে, তা বলা মুশকিল।’ তিনি বলেন কীভাবে প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়াতে পারে এ ব্যাপারে বিএসইসিই আমাদের পরমর্শ দিয়েছে। তারা বলেছে প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন বাড়াতে।