'আম্মু আব্বু কোথায়? আব্বু কখন আসবে! কেন বাসায় আসে না?'-এমন প্রশ্নের জানা নেই উত্তর। এভাবেই বাবাকে খুঁজে বেড়ায় ছোট্র জারা ও জাবির। রাত হলেই বাবাকে খুঁজে ফিরে মাসুম বাচ্চাগুলো। এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন সুরাইয়া সুলতানা।
বলছি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকার পাঠানপাড়া আতিয়া মহলে জঙ্গি হামলায় নিহত শহীদ বীরসেনা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজাদের পরিবারের কথা। ২০১৭ সালের ২৫ মার্চে মারা যান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজাদ।
তৎকালীন র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। তার চলে যাওয়ার পাঁচ বছর আজ। সহকর্মীর জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া এমন বীরসেনার মহতী ঘটনা হয়ত আগে কখনো ঘটেছে কিনা জানা নেই।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজাদের স্ত্রী সুরাইয়া সুলতানা বলেন, সেই যন্ত্রণা প্রতিনিয়ত দগ্ধ করছে আমাকে। এখনো মনে পড়লে মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিছুতেই ভুলতে পারি না সেই স্মৃতিগুলো। ছোট ছেলে জাবির ও মেয়ে জারা তখন কিছুই বোঝে না। বড় ছেলেও ছিল ছোট।
তিনি বলেন, এখনো ওরা বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। ড্রয়িং রুমে দেয়ালে সাটানো বাবার ছবিগুলোই তাদের কাছে শেষ স্মৃতি। ওদের বাবা-মা সবই এখন আমি। বড় ছেলে জারিফ টাঙ্গাইল মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে মেয়ে জারা ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ও ছেলে জাবির কেজিতে পড়ছে। আমি আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে শিক্ষকতা করছি।
২০১৭ সালের ২৫ মার্চ সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকার পাঠানপাড়া আতিয়া মহলের কথা হয়তো ভুলে গেছেন অনেকেই। সেদিন নজর ছিল সিলেটের আতিয়া মহলের দিকে। তাকিয়ে ছিল সবাই টেলিভিশনের পর্দায়। জঙ্গি নামক এক আতঙ্ক তখন সারাদেশকে তাড়া করছিল।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজাদ দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন চাকরি জীবনে। অর্জন করেছিলেন অনেক সম্মান। একনজরে দেখা নেয়া যাক সেই বীরসেনার ইতিহাস-
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজাদের জন্ম ১৯৭৫ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজিতে এমএ করেন। ১৯৯৬ সালে ৩৪ তম বিএমএ লং কোর্স সম্পন্ন করেন। ২০১১ সালে এলিট ফোর্স খ্যাত র্যাব-১২ এর কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান। ওই বছরই তাকে পদোন্নতি দিয়ে গোয়েন্দা বিভাগের উপ-পরিচালক করা হয়। ২০১৩ সালে তিনি র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হন।
অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বিপিএম (মরণোত্তর) পেয়েছেন তিনি। কর্নেল আজাদ ২০০০ সালের ৩০ ডিসেম্বর উত্তরবঙ্গের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনতার অন্যতম সংগঠক মইনুদ্দিন আহমেদ মন্টু ডাক্তারের মেয়ে সুরাইয়া সুলতানা শর্মির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
কী ঘটেছিল সেদিন?
জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৫ মার্চ সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকার পাঠানপাড়া আতিয়া মহল নামে একটি বাড়িতে জঙ্গিদের অবস্থানের খবর পেয়ে বাড়িটি ঘিরে রাখে পুলিশ। পরদিন সকালে ওই বাড়ি থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়ে জঙ্গিরা। সেদিন ঢাকা থেকে বিশেষ টিম সোয়াতকে জঙ্গি দমন করার জন্য পাঠানো হয়।
কিন্তু কোনোভাবেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। উপায় না পেয়ে সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো দল ঘটনাস্থলে গিয়ে পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদ ঘটনাস্থলে হঠাৎ লক্ষ্য করেন পুলিশের একজন সদস্য বোমাসদৃশ্য পলিথিন মোড়ানো একটি বস্তু লাঠি দিয়ে দেখছেন। এ অবস্থায় কর্নেল আজাদ ‘ডোন্ট টাচ-ডোন্ট টাচ’ বলতে-বলতে এগিয়ে যান তার টিমমেটদের জীবন রক্ষার্থে। কাছে যেতেই বোমাটি ফেটে যায়। আহত হন আজাদসহ কয়েকজন। আতিয়া মহলের পাশে দফায় দফায় বিস্ফোরণ ঘটে। আজাদের মস্তিষ্কে বোমার স্প্লিন্টার ঢুকে যায়।
আজাদকে সিলেট থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় ২৯ মার্চ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ৩১ মার্চ রাতে আবুল কালাম আজাদ মারা যান। সেদিন বিকেলে বনানী সামরিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।