বহুল আলোচিত এবং চাঞ্চল্যকর রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায় জাহিদুল ইসলাম টিপু এবং সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড এবং টিপুকে অনুসরণকারীসহ ৪ জনকে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
শনিবার (০২এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব জানান।
তিনি বলেন, র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৩ এর অভিযানে গত রাতে রাজধানীর মুগদা, শাহজাহানপুর ও মিরপুর এলাকা হতে ঘটনার অন্যতম পরিকল্পনাকারী (১) ওমর ফারুক (৫২) পিতা. মো. আব্দুর রহিম, সুধারাম, নোয়াখালীসহ পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত, (২) আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ (৩৮) পিতা. মৃত আবু সাইদ, পটিয়া, চট্টগ্রাম, (৩) মো. নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির (৩৮), পিতা. মৃত মো. ইসমাইল, নড়িয়া, শরীয়তপুর এবং (৪) মো. মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ (৫১), পিতা. মৃত মো. মকছুদুল হককে রংপুরের গংগাচড়া থেকে গ্রেফতার করা হয়।
অভিযানে উদ্ধার করা হয় নজরদারীর কাজে ব্যবহৃত মোটর সাইকেল, হত্যার কাজে প্রদান যোগ্য ৩ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা এবং মোবাইলসহ অন্যান্য সামগ্রী। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে।
গ্রেফতারকৃতরা র্যাবকে হত্যাকাণ্ডের মোটিভ বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানায় যে, দীর্ঘদিন যাবৎ ভিকটিম ও হত্যার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বিরোধ বিদ্যমান ছিল। মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজের ভর্তি বাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলমান রয়েছে।
দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরম্পরায় গত ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই তারিখে গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ড এর সামনে মিল্কী হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হয়। মিল্কী হত্যাকান্ডের ৩ বছরের ভিতর একই এলাকার বাসিন্দা রিজভি হাসান ওরফে বোচা বাবু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, মিল্কী হত্যাকান্ডের সঙ্গে টিপুর সম্পৃক্ততা রয়েছে মর্মে গ্রেফতারকৃত ওমর ফারুক, পলাশসহ একটি পক্ষ মানববন্ধন, আলোচনা সভা, পোস্টার লাগানো ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ ছাড়া বাদীর মাধ্যমে চার্জশিটের নারাজী প্রদানের মাধ্যমে চেষ্টা চালায়। ত
থাপি জাহিদুল ইসলাম টিপু মিল্কী হত্যা মামলা হতে অব্যাহতি পায়। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত ওমর ফারুক ও অন্যান্য সহযোগীরা স্বার্থগত দ্বন্দের কারণে টিপুর অন্যতম সহযোগী রিজভী হাসানকে ২০১৬ সালে হত্যা করে। বর্তমানে রিজভী হাসান হত্যাকাণ্ডটি দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের মাধ্যমে বিচার কার্য শুরু হয়।
গ্রেফতারকৃতরা জানায়, তাদের ধারণা প্রতিপক্ষ টিপুর কারণেই রিজভী হাসান হত্যাকাণ্ডটি দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে স্থানান্তরিত হয়েছে। ইতোমধ্যে মামলার বাদী রিজভী হাসান বাবুর পিতা আবুল কালামের সঙ্গে গ্রেফতারকৃত ওমর ফারুক ও তার সহযোগীরা ৫০ লক্ষ টাকায় দফারফা করার চেষ্টা করে।
তথাপিও জাহিদুল ইসলাম টিপুর কারণে কালাম মিমাংসায় আসেনি বলে গ্রেফতারকৃতরা জানায়। অধিকন্তু জাহিদুল ইসলাম টিপু কালামকে নিয়ে সার্বক্ষণিক চলাচল করতে থাকে। তারা এক পর্যায়ে কালামকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে, কিন্তু জাহিদুল ইসলাম টিপুর সঙ্গে চলাচল করার কারণে তা সম্ভব হয়নি।
অতঃপর তারা যখন দেখল কালামের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়ে যায়, তখন তারা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করে যাতে মামলা পরিচালনা ধীরগতি করা যায়।
তাদের ধারণা বাদী কালাম একা মামলাটি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হবে না। এরই প্রেক্ষিতে প্রায় ৩ মাস আগে সাক্ষ্য শেষে আদালত চত্ত্বর এলাকায় হত্যাকাণ্ড সংগঠনের প্রাথমিক আলোচনা করে।
গ্রেফতারকৃতরা আরো জানায় যে, রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সাক্ষী গ্রেফতারকৃত মো. মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশকে তারা অর্থের বিনিময়ে সাক্ষ্য প্রদানে বিরত থাকতে বলে।
গ্রেফতারকৃত মোরশেদুল আলম রাজী থাকা সত্বেও জাহিদুল ইসলাম টিপুর চাপে সে সাক্ষ্য দেয়। মোরশেদুল আলম পরবর্তীতে রিজভী হাসান হত্যাকাণ্ডের গ্রেফতারকৃত আসামীদের সাথে যুক্ত হয়ে জাহিদুল ইসলাম টিপুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অংশ নেয়।
গ্রেফতারকৃত মোরশেদুল আলম হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য ফারুক ও মুসাকে ফোনে কয়েকজন আন্ডার ওয়ার্ল্ড এর সন্ত্রাসীদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। হত্যাকাণ্ডটি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সমন্বয়ের জন্য মুসা গত ১২ মার্চ ২০২২ তারিখ দুবাই গমন করে। সেখানেই হত্যাকাণ্ড সংঘঠনের চুড়ান্ত সমন্বয় করা হয়।
গ্রেফতারকৃতরা জানায় যে, হত্যাকাণ্ডটি দেশে সংঘঠিত হলেও নিয়ন্ত্রণ করা হয় দুবাই হতে। দেশ হতে নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশসহ আরো কয়েকজন জাহিদুল ইসলাম টিপুর অবস্থান সম্পর্কে বেশ কয়েকদিন যাবত মুসার কাছে তথ্য প্রেরণ করত।
ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর গ্রেফতারকৃত মো. নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির আনুমানিক চারবার জাহিদুল ইসলাম টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসাকে অবহিত করে। পরবর্তীতে জাহিদুল ইসলাম টিপুর গ্রান্ড সুলতান রেস্টুরেন্ট হতে বের হওয়ার সময় মো. মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ তাকে নজরদারিতে রাখে এবং তার অবস্থান সম্পর্কে সে ফ্রিডম মানিককে অবহিত করে।
বর্ণিত অবস্থান সম্পর্কে জানানোর প্রেক্ষিতে আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টায় আন্ডার ওয়ার্ল্ড এর তত্ত্বাবধানে কিলার কর্তৃক হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হয় বলে গ্রেফতারকৃতরা জানায়।
জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, গ্রেফতারকৃত ওমর ফারুকের সাথে বর্ণিত হত্যাকাণ্ডের জন্য ১৫ লক্ষ টাকার চুক্তি হয়। ওই ১৫ লক্ষ টাকা রিজভী হাসান হত্যাকাণ্ডের আসামীদের মধ্যে ওমর ফারুক ৯ লক্ষ; অবশিষ্ট অর্থ মো. নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ এবং মুসা প্রদান করে।
দুবাইয়ে গমনের সময় মুসা ৫ লক্ষ টাকা নিয়ে যায় এবং হুন্ডির মাধ্যমে মুসাকে আরো ৪ লক্ষ টাকা প্রেরণ করা হয়। অবশিষ্ট ৬ লক্ষ টাকা দেশে হস্তান্তর করার চুক্তি হয়। উল্লেখ্য যে, মুসা ২০১৬ সালে রিজভী হাসান হত্যাকাণ্ডের চার্জশীটভূক্ত ৩নং আসামী।
গ্রেফতারকৃত ওমর ফারুক বর্ণিত টিপু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম পরিকল্পনাকারী। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সাথে যোগাযোগ স্থাপন ও হত্যাকাণ্ড সংগঠনের জন্য তত্ত্বাবধান ও অর্থ লেনদেন করে। গ্রেফতারকৃত ওমর ফারুক ২০১৬ সালে রিজভী হাসান হত্যাকান্ডের চার্জশীটভূক্ত ৪নং আসামী এবং উক্ত মামলায় সে ইতোপূর্বে কারাভোগ করে।
গ্রেফতারকৃত নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির বর্ণিত হত্যাকানণ্ড সংঘঠনের সময় জাহিদুল ইসলাম টিপুকে নজরদারী ও হত্যাকাণ্ডের জন্য অর্থ প্রদান করেছে। ঘটনাস্থলের সন্নিকটে তাকে সাদা শার্ট, জিন্স প্যান্ট ও কেডস্/জুতা পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়।
ঘটনা পরবর্তীতে সে তার মোবাইল ফ্লাশ করে বিক্রি করে দেয় ও সীমকার্ড ভেঙ্গে ফেলে। র্যাব পরবর্তীতে উক্ত মোবাইলফোন ও সীমকার্ড উদ্ধার করে। এ ছাড়া ঘটনার আগের দিন সে সীমান্তবর্তী চৌদ্দগ্রাম এলাকায় একদিন অবস্থান করেছিল। সে রিজভী হাসান বাবু হত্যাকান্ডের ১ নং চার্জশীটভূক্ত আসামী। তার নামে অস্ত্র আইনে পল্লবী থানায় আরো ১ টি মামলা রয়েছে।
গ্রেফতারকৃত মোরশেদুল আলমওরফে কাইল্লা পলাশ ঘটনার দিন জাহিদুল ইসলাম টিপুকে নজরদারী ও আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সাথে সমন্বয় করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডটি বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে। ইতোপূর্বে সে মতিঝিল থানায় অস্ত্র আইনের একটি মামলায় কারাভোগ করেছে।
গ্রেফতারকৃত আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ ঘটনার পরিকল্পনা ও অর্থ প্রদানের সাথে জড়িত। সে রিজভী হাসান বাবু হত্যাকান্ডের ২ নং চার্জশীটভুক্ত আসামী। তার নামে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অপরাধে ১২টি মামলা রয়েছে এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছে।
উল্লেখ্য, গত ২৪ মার্চ রাত আনুমানিক সাড়ে দশটায় দুস্কৃতিকারীর গুলিতে জাহিদুল ইসলাম টিপু নিহত হয়। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে একজন নিরীহ কলেজ ছাত্রী নিহত হয়। উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহত জাহিদুল ইসলাম টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি শাহজাহানপুর থানায় একটি মামলা রুজু করেন। গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।