logo
আপডেট : ৩ এপ্রিল, ২০২২ ১০:২২
মেডিকেল শিক্ষায় প্রতিবন্ধী চিকিৎসার বিষয় পাঠ্যবইয়ে নেই
নিখিল মানখিন ও আরিফ সাওন

মেডিকেল শিক্ষায় প্রতিবন্ধী চিকিৎসার বিষয় পাঠ্যবইয়ে নেই

প্রতীকী ছবি

দেশের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য নির্ধারিত পাঠ্যক্রম নেই। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছ থেকে প্রতিবন্ধীরা সঠিক চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে আছে নানা প্রতিবন্ধকতা। ফলে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৫ ভাগ প্রতিবন্ধী যথাযথ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বেসরকারি সংগঠন অ্যাকশনএইডের ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য অধিকার সুরক্ষা : রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও প্রতিষ্ঠানগত ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতা ’ শীর্ষক গবেষণায় এ তথ্য দেওয়া হয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবন্ধী মানুষকে অন্য অসুস্থ মানুষের কাতারে ফেলে দেওয়া হয়। যার মূল কারণ সচেতনতার অভাব। যারা আইননীতি করছেন তারা সচেতন নন। অনেক ক্ষেত্রে তারা ভালোভাবে বিষয়টা বোঝেন না বা উপলব্ধি করেন না। দেশের প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সরকারের উচিত আলাদা একটি বিভাগ করা।

গবেষণায় আরো বলা হয়, শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম মানুষগুলো সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে কোনো রকম সহযোগিতা না পাওয়ায় চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। সরকার, দাতা সংস্থা, এনজিও এমনকি সুশীল সমজের কাছেও প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন ও সেবা অগ্রাধিকার পায়নি। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, পদে পদে হয়রানি পোহাতে হচ্ছে তাদের। তাদের চিকিৎসায় নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, দক্ষ জনবল ও পর্যাপ্ত অবকাঠামো। প্রতিবন্ধীদের জন্য বিদ্যমান ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টারগুলোতে তারা যথাযথ সেবা পান না। সেখানে দক্ষ লোকের অভাব আছে। আবার অনেক সময় দেখা যায় প্রতিবন্ধীদের দেখলে অনেক চিকিৎসক নানারকম কুৎসিত মন্তব্য করেন এবং চিকিৎসাসেবা দিতে অসম্মতি জানান। সরকারি বা বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই প্রতিবন্ধীবান্ধব টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। যে কারণে প্রতিবন্ধীরা নানা সমস্যায় পড়েন। এসব কারণেই দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৫ ভাগ প্রতিবন্ধী মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত থাকছে। গবেষণায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে সমন্বিত উদ্যোগ, প্রতিবন্ধীবান্ধব আইনের বাস্তবায়ন, চিকিৎসাসেবা সম্প্রসারণ, চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিবন্ধীদের নিয়ে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তি বাজেটে বরাদ্দ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয় গবেষণা প্রতিবেদনে।

গবেষণায় দেখা গেছে, এমবিবিএস শিক্ষা কারিকুলামে একটি বিষয়ও নেই যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসার কথা বলা আছে। যে কারণে একজন শ্রবণ বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী যখন চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যান তখন ডাক্তাররা তার চিকিৎসা করতে নানা সমস্যায় পড়েন। আবার কখনো কখনো এসব প্রতিবন্ধীর চিকিৎসা দূরের কথা নানারকম হয়রানি এবং তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়। আইন ও নীতিমালায় প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রায়োগিক বা লিখিত কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি অসম্ভব ব্যাপার।

গবেষণায় দেখা গেছে, সরকার, দাতাসংস্থা, এনজিওসমূহ এমনকি সুশীল সমাজের কাছেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা এবং উন্নয়ন অগ্রাধিকার পায়নি। গবেষণার আলোকে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সুপারিশে বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। তাদের চিকিৎসাসেবা বাড়াতে হবে। চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিবন্ধীদের নিয়ে পাঠ্যক্রম থাকতে হবে। বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সর্বোপরি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য পাঠ্যক্রম থাকার বিষয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, এ বিষয়ে পাঠ্যক্রম নেই তা পুরোপুরি ঠিক নয়। পুরো বিষয়টি একসঙ্গে নেই। চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে বলে জানান অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় জানায়, বর্তমান বিশ্বে প্রতিবন্ধী শব্দটি পরিবর্তন হয়ে এখন তাদের বলা হয় ‘বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন মানুষ’। সরকার এ ধরনের বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নির্ধারণ, দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ, নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান, ছবিসহ ডাটাবেজ প্রস্তুত এবং লক্ষ্যভুক্তির কৌশল সহজতর করার লক্ষ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তির শনাক্তকরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল বিশেষায়িত হাসপাতাল অ্যান্ড নার্সিং কলেজে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষ করে অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশু ও মহিলাদের কমপক্ষে শতকরা ৩০ ভাগ দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদাান করা হচ্ছে।

ভবিষ্যতে অধিকসংখ্যক প্রতিবন্ধী শিশুদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করার পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে। অ্যাসিডদগ্ধ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধীদের কারিগরি শিক্ষা প্রদানের জন্য পিএইচটি সেন্টার, সরকারি বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, সরকারি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম ও জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (ইআরসিপিএইচ), শারীরিক প্রতিবন্ধীদের গ্রামীণ পুনর্বাসন উপকেন্দ্র (আরআরসি), জাতীয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কল্যাণে জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী সেবা, সাহায্য কেন্দ্র কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে।

সারাদেশের ৬৪টি জেলা ও ৩৯টি উপজেলায় সর্বমোট ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এ সকল কেন্দ্রমূহ হতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অটিজমসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে থেরাপিউটিক, কাউন্সেলিং ও রেফারেল সেবা এবং সহায়ক উপকরণ প্রদান করা হচ্ছে। দেশের ৫৫টি বেসরকারি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের ১০০ ভাগ বেতন-ভাতা সরকারিভাবে পরিশোধ করা হচ্ছে। সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা প্রণয়নের ফলে প্রতিবন্ধী স্কুলগুলোতে সার্বিক কর্মকাণ্ডে আগের তুলনায় অনেক বেশি গতি সঞ্চার হয়েছে।

সমাজকল্যাণ মন্তণালয় জানায়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন দেশের অনগ্রসর, বঞ্চিত, অসহায়, প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক এবং জন্মগতভাবে কিংবা অন্য যেকোনো কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কল্যাণ, উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও ক্ষমতায়নের জন্য বহুমাত্রিক সেবা প্রদান করছে।

দেশের প্রতিবন্ধী এ জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপি ও অন্যান্য চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ২০০৯-২০১০ অর্থ বছরে দেশের পাঁচটি জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র চালু করা হয়। পর্যাক্রমে সকল উপজেলা প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র, অটিজম কর্নার, টয় লাইব্রেরি কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হবে। এসকল সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রসমূহ হতে প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক এবং জন্মগতভাবে কিংবা অন্য যেকোনো কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাক্তিকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে থেরাপি, ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি সেবার পাশাপাশি কাউন্সেলিং, পরামর্শ, তথ্য এবং রেফারেল সেবা প্রদান করা হচ্ছে।