দুর্বিষহ হয়ে উঠছে রাজধানী ঢাকার জনজীবন। টানা যানজটের সঙ্গে যোগ হয়েছে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণসহ নানা ঝঞ্ঝাট। গ্রীষ্ম শুরু না হতেই ভ্যাপসা গরমে নাভিশ্বাস উঠেছে নগরবাসীর। বাড়ছে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব। বায়ুদূষণের সঙ্গে ডায়রিয়ার যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। শুধু ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাবেই নয়, বায়ু আর শব্দদূষণের কারণে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্যাস সংকট। গ্যাসের চুলা ঠিকমতো জ্বলছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সার্বিক বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে রাজধানী বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে পড়ে অনেকে নাকাল হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টেও জানা গেছে, যানজটের কারণে রাজধানীর গাড়ির গতি ঘণ্টায় ৭ কিলোমিটারের নেমেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই এ গতি ৪ কিলোমিটারের নেমে আসবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্যামের কারণে যত সময় রাস্তায় আটকে থাকতে হয়, হেঁটে গেলে তার আগেই গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব। অথচ দুর্বিষহ এই যানজটের হাত থেকে রেহাই পেতে রাজধানীতে বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। মেট্রোরেল ছাড়া অনেক প্রকল্পই বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু যানজট থেকে মুক্তি অধরাই থেকে গেছে।
৩ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে মাহে রমজান। রমজান শুরু না হতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং শুরু হয়েছে। গ্যাস না থাকায় প্রথম রোজায় অনেকে ইফতার সেরেছেন হোটেলে গিয়ে। এ বিষয় নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়েছে। খোদ সরকারদলীয় এমপিরা সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন। যদিও সংসদে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট। চাহিদার পরিমাণ রয়েছে গড়ে প্রতিদিন ১৩ থেকে সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদা অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে।
গতকাল সোমবার সকাল থেকেই রাজধানীতে ছিল তীব্র যানজট। সময়মতো কেউ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। ফার্মগেট, বাংলামোটর, গ্রিনরোড, পান্থপথসহ বিভিন্ন সড়কে গাড়ি আটকে ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। চৈত্রের প্রচণ্ড গরমে যানজটে আটকেপড়া মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। যদিও ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রমজানে অফিস সময় কমে যাওয়ায় রাস্তায় বেশি গাড়ি বের হওয়ার কারণে যানজট বেড়েছে। এছাড়া একই সময়ে স্কুলগামী শিক্ষার্থী ও অফিসগামী মানুষ গন্তব্যের উদ্দেশে বের হওয়াটা এবং সেইসঙ্গে রাস্তার উন্নয়ন কাজও একটা বড় কারণ।
রমজানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে রাজধানীবাসী। যদিও সরকার থেকে বলা হচ্ছে করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। তবে সরেজমিন বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, রমজান শুরু হওয়ার পর থেকে বাজারে অনেক জিনিসের দাম আকাশচুম্বী। রমজান শুরু আগে যে বেগুনের দাম ৬০ টাকা কেজি শসা ৪০ টাকা কেজি ছিল। রমজানের শুরুতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ টাকা পর্যন্ত। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় এবারের রমজানে ইফতার ও সাহরির তালিকা অনেকে কাটছাঁট করেছে। গরুর মাংসের দাম উঠেছে প্রায় ৮০০ টাকা কেজিতে। তেলে দাম আগ থেকেই বাড়তি। ফলে দ্রব্যমূল্য নিয়ে সাধারণ মানুষ অস্থির।
যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সংসদে বক্তব্য রেখেছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক। তিনি বলেন, সড়কমন্ত্রী পরিবহণ ব্যবস্থাপনা ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকা শহরে গাড়ি চলে না। পরিবহণ অপ্রতুল। ঘর থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। বিষয়টিতে দৃষ্টি দেওয়ার জন্যও অনুরোধ করেন তিনি।
দ্রব্যমূল্য বা যানজট নয়। আবহাওয়া অস্বাভাবিক আচরণে নিয়েও ভোগান্তি কম পোহাতে হচ্ছে না। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বছরের শুরু থেকেই আবহাওয়া অস্বাভাবিক আচরণে করছে। গত মার্চে তাপমাত্রা পৌঁছে যায় ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি। ফেব্রুয়ারি পর থেকে বৃষ্টির দেখা নেই। এরই মধ্যে এপ্রিল মাসের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বৃষ্টিপাত না হওয়ায় টানা তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, বছরের শুরুতেই এ অস্বাভাবিক অবস্থা চলছে। বিস্ময়কর হলেও এপ্রিলের প্রচণ্ড গরমের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের কোথাও কোথাও শীতের আমেজ বিরাজ করছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ভারত মহাসাগরের অস্বাভাবিক অবস্থার প্রভাবেই এমনটি হচ্ছে। এর প্রভাব কতটা কেমন হবে তার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
এদিকে টানা তাপপ্রবাহের কারণে রাজধানীতে ডায়রিয়া হু-হু করে বাড়ছে। আইসিডিডিআর,বির তথ্য বলছে, প্রতিদিন রাজধানীতে ১ হাজারের ওপরে শিশুরা ডায়ারিয়া আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া সারা দেশে ২ হাজারের বেশি শিশু ডায়ারিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এর কারণে হিসেবে তারা বলছেন, বাইরের খোলা খাবার এবং বিশুদ্ধ পানির অভাইে মূলত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রচণ্ড গরমে খাদ্য মান বেশিক্ষণ বজায় থাকছে না। ফলে অনেকেই বাসি খাবার খেয়েও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। যার সঙ্গে এ বছরের অস্বাভাবিক তাপমাত্রার সম্পর্ক রয়েছে।
ঢাকার বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের যন্ত্রণাও আজকের নয়। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে এ দুটি দূষণ রাজধানীতে সীমা অতিক্রম করেছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে বায়ু এবং শব্দদূষণের তালিকায় রাজধানী ঢাকার বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্যঝুঁকি ছাড়াও বায়ুদূষণ মানুষের গড় আয়ু কমে দিচ্ছে।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির প্রকাশ করা এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন বা নির্দেশনা অনুযায়ী মানুষের জন্য ঘরের ভেতর শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর ঘরের বাইরে বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকায় এ মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল। শব্দদূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে সড়কে যানজটকালে যানবাহন থেকে নির্গত শব্দ, উড়োজাহাজ, ট্রেন, শিল্পকারখানা ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট শব্দ। এসব শব্দ মানমাত্রার চেয়ে বেশি হলে তা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপদে ফেলে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং শব্দ ও বায়ুদূষণের কারণে গর্ভবর্তী মায়েরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে গর্ভের সন্তানের মস্তিষ্ক যেভাবে বিকশিত হওয়ার দরকার সেটা হচ্ছে না। এই দূষিত বায়ুতে এক ধরনের পদার্থ থাকে, যেটা মস্তিষ্ক বিকাশে বড় ধরনের বাধা। বর্তমানে পরিস্থিতি এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ের দিকে চলে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।