logo
আপডেট : ৫ এপ্রিল, ২০২২ ০৯:৪৭
পাকিস্তানে পঁচাত্তর বছরেও পরিপক্বতা পায়নি গণতন্ত্র
মোমেনা আক্তার পপি

পাকিস্তানে পঁচাত্তর বছরেও পরিপক্বতা পায়নি গণতন্ত্র

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ফাইল ছবি- ডন

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ থেকে স্বাধনীতা লাভের পর ৭৫ বছর বয়স হতে চলল পাকিস্তানের। কিন্তু দেশটিতে এখনো অস্থিরতার বিরাজ করছে। সেনা-নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির কারণে এত বছরেও দেশটিতে পরিপক্বতা পায়নি গণতন্ত্র। ফলে উন্নতির পরিবর্তে দিনদিন অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশটি। বছরের পর বছর ধরে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব, ধর্মীয় আধিপত্যবাদের চেষ্টা, সেনা শাসন ও রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ- সব মিলিয়ে জন্মের পর থেকেই দেশটি নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারছে না। বর্তমানে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্য দেশের চাপ। এটা সংকটকে আরো জটিল করে তুলেছে।

সেনা শাসন বাদ দিলে দেশটিতে যতবারই নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসেছে কেউ তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। দুর্ঘটনায় মৃত্যু, হত্যা, সেনা অভ্যুত্থান এবং রাজনৈতিক কোন্দলে কোনো নেতাই পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। সর্বশেষ প্লেবয় হিসেবে পরিচিত সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানকেও একই পরিণতি ভোগ করতে হলো। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে অনাস্থা প্রস্তাবের মুখে পড়ে ইমরান খান পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেন। প্রেসিডেন্ট গত রোববার পার্লামেন্ট ভেঙে দেন। নিয়ম অনুযায়ী এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হবে এবং তারা পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করবেন। হয়তো নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইমরান খান আবারো রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসবেন। কিন্তু তখনো কি তিনি তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবেন- এটাই এখন রাজনীতি সচেতন মানুষের মনে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ২২ জন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে পাকিস্তান। একজন নারী প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন দেশটিতে। তিনি হলেন বেনজির ভুট্টো। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তিন বছর আট মাস দায়িত্ব পালনের পর তার সরকার বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি ক্ষমতায় আসেন। তার সরকারকে বিলুপ্ত ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত দ্বিতীয়বার তিন বছর ১৭ দিন দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন।

গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান। কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী দেশটির রাজনীতিতে সবসময় বড় খেলোয়াড় হিসাবে ছিল এবং আছে। সরকারকে বিলুপ্ত ঘোষণা, বরখাস্ত বা সেনা আইন জারি করে বারবার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে সেনাবাহিনী। যদিও ইমরান ইস্যুতে সেনাবাহিনী জানিয়েছে- তারা রাজনীতিতে নেই।

ক্রিকেটার থেকে তেহরিক-ই ইনসাফ (পিটিআই) দল গড়ে রাজনীতিতে নামা ইমরান ২০১৮ সালে ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রী হলেও তার পেছনে সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ ছিল- এমনটাই ধারণা। সম্প্রতি তার সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কয়েক মাস আগে গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই প্রধান নিয়োগ নিয়ে বিরোধটা প্রকাশ্যে আসে। এ নিয়ে মনোমালিন্যের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান ভিন্ন মত দেন।

ইমরান অভিযোগ করেন, ওয়াশিংটন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করছে। অন্যদিকে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষ নেন জেনারেল বাজওয়া। পাকিস্তানের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহম্মদ আলী বা পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো কেউ কেউ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেছেন। এ ছাড়া পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপেও কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে।

২০০৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত টানা তিনজন প্রধানমন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণা করেন সুপ্রিম কোর্ট। এ পর্যন্ত সব থেকে দুর্ভাগা প্রধানমন্ত্রী বলা যায় নওয়াজ শরীফকে। তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেও একবারও মেয়াদ শেষ করতে পারেননি তিনি। প্রথমবার প্রেসিডেন্ট বরখাস্ত করেন, দ্বিতীয়বার সেনাআইন জারি হয় এবং তৃতীয়বার সুপ্রিম কোর্ট তাকে অযোগ্য ঘোষণা করে।

দুর্নীতি, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অভিযোগ তুলে গত ৮ মার্চ বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইমরানের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব দাখিল করে। সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে টিকে রইলেন ইমরান। তবে এবারের দৃশ্যপটেও মূল খেলোয়াড়দের একজন হলেন- নওয়াজ শরীফের ভাই শাহবাজ শরীফ।

ইমরান যদি ক্ষমতাচ্যুত হতেন তাহলে তিনিই প্রধানমন্ত্রী পদে প্রধান প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হতেন। তার ভাই নওয়াজ অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় এবং পানামা পেপারসে নাম আসায় ভাবমূর্তি সংকটে আছেন। ফলে তার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। বতর্মানে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের প্রেসিডেন্ট ৭০ বছর বয়সি শাহবাজ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

এ ছাড়াও দৃশ্যপটে নাম এসেছে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি ও বিলওয়াল ভুট্টো জারদারির নাম। ধনী সিন্ধি পরিবারের ছেলে জারদারিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে বিয়ে করেন বেনজির ভুট্টো। মি. টেন পার্সেন্ট হিসেবে পরিচিত জারদারি- দুর্নীতি, মাদক চোরাচালান ও খুনের অভিযোগে দুবার জেল খেটেছেন। ২০০৭ সালে বন্দুকধারীদের হামলায় বেনজির নিহত হলে জারদারি পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান হন। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তিতে তিনি প্রেসিডেন্ট হন।

পাকিস্তানের সাবেক ও প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি। ২০০৭ সালে তার মা নিহত হলে তিনি মাত্র ১৯ বছর বয়সে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান হন। অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করা ৩৩ বছর বয়সি বিলাওয়াল প্রগতিশীল রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রায়ই নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন। পাকিস্তানের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশির বয়স ২২ বছর ও তার নিচে। যোগাযোগমাধ্যমে বিলাওয়াল সেখানে তরুণদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়।

পাকিস্তানে রাজনীতির জটিল আবর্তে আরেকটি নাম উঠে এসেছে। তিনি হলেন- মাওলানা ফজলুর রহমান। ধর্মীয় কট্টরপন্থি হিসেবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি কিছুটা নমনীয় হয়েছেন। ফলে বাম-ডানপন্থি ও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সঙ্গে জোট করতে তিনি কার্পণ্য করেন না। তার ক্যারিসমাটিক বক্তব্যে হাজার হাজার মাদ্রাসা ছাত্র জড়ো হয়। যদিও তার দল জেইউআই-এফ এককভাবে ক্ষমতায় আসার মতো জনপ্রিয় কখনোই ছিল না। তবে মাদ্রাসা ছাত্রদের ওপর প্রভাব- রাজনীতিতে তাকে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবেই টিকিয়ে রেখেছে। ব্রিটিশ নাগরিক জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করায় ইমরান খানকে তিনি অপছন্দ করতে শুরু করেন। এরপর থেকে তিনি ইমরানকে একজন ইহুদি বলেই ডাকেন। অন্যদিকে জ্বালানি লাইসেন্স দুর্নীতিতে জড়িত থাকায় ইমরান তাকে মোল্লা ডিজেল বলে সম্বোধন করেন।

ডন, জিও নিউজ ও আলজাজিরা অবলম্বনে