হাওর অধ্যুষিত জেলা সুনামগঞ্জ। ছোট বড় মিলিয়ে এ জেলায় ১৫৩টি হাওরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই হাওর রক্ষায় প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা দিচ্ছে সরকার।
কারণ একটাই। সুনামগঞ্জের কৃষকের একমাত্র ফসল বোরো ধানের সুরক্ষা। তবে প্রতিবছর কাজ নিয়ে নানান অভিযোগ থাকলেও ২০১৭ সালের অকাল বন্যায় সকল ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর চলতি বছর অভিযোগের মাত্রা যেন আরও বেড়েছে তিনগুণ। এদিকে ভারতের আসামের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে এখন পর্যন্ত পাঁচ হাওরে পানি প্রবেশ করেছে, যার মধ্যে হাওরের ১৫০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্যানুযায়ী, মঙ্গলবার সকালে সুনামগঞ্জের সুরমা ও যাদুকাটা নদীর পানি কিছুটা কমলেও প্রতিবেদন লেখার আগ পর্যন্ত (বিকেল ৫টা) তা স্থিতিশীল ছিল। সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ছয় সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত ও বাংলাদেশে আপাতত কোনো বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় হাওরের পানি কমতে শুরু করতে পারে।
অন্যদিকে মঙ্গলবার (৫ মার্চ) পর্যন্ত সুনামগঞ্জের চারটি হাওরে পানি প্রবেশ করেছে, যার সবগুলোই ছোট হাওর। হাওরগুলো হলো- সুনামগঞ্জ সদরের ছোট কানলা, তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার, ছাতকের গুয়া পাকুয়া এবং শাল্লার বাঘার হাওর।
এছাড়া বৃষ্টির ঢলের স্রোতে অধিকাংশ হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা মেরামতের জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন।
এদিকে হাওর ও ফসল রক্ষায় মাঠে কাজ করা সংগঠন হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু না করা এবং বাঁধের কাজ এবং পিআইসি গঠনে অনিয়মের ফলে হাওরের সকল বাঁধ এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। প্রশাসনকে শুরু থেকে সর্তক করে আসলেও কাজ শেষ না হওয়ায় ক্ষুব্ধ তারা।
জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থ বছরে সুনামগঞ্জের ৭২৪ পিআইসি কমিটি গঠনের মাধ্যমে ৫৩২ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার বাঁধ সংস্কার ও মেরামত করা হচ্ছে, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৪ কোটি টাকা।
গেল বছরের ১৫ ডিসেম্বর হাওরের বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করার কথা থাকলেও তা সীমাবদ্ধ ছিল উদ্বোধনের ছবির মধ্যেই। কাজ শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও দুই দফা সময় বাড়িয়ে এখনো শেষ হয়নি বাঁধের কাজ। চলমান কাজের মধ্যেই অধিকাংশ বাঁধে দেখা দিয়েছে ফাটল এবং ভাঙন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাহিরপুর উপজেলার অন্যতম বড় মাটিয়ান হাওরের আনন্দনগর বাঁধের বেশ কিছু জায়গা দেবে গেছে। দেখা দিয়েছে ফাটল। মধ্যনগর উপজেলায় শালদিঘা হাওরে বাঁধের মাটি সরে গেছে। এছাড়া সুনামগঞ্জের দিরাই, জগন্নাথপুর, জামালগঞ্জ এবং ধর্মপাশা উপজেলার বেশ কয়েকটি বাঁধের কাজ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কাগজে কলমে হাওরের বাঁধ নির্মাণে মাটির কাজের পর ঘাস লাগানোর দায়িত্ব থাকলেও তা করেনি অধিকাংশ হাওরের পিআইসির সদস্যরা।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ছোট কানলার হাওরের কৃষক লিলু মিয়া বলেন, ‘অনেক কষ্টে মহাজনের কাছ থাকি টাকা সুদে আনিয়া ধান লাগাইছলাম। এখন অসময়ে পানি আইয়া সব নিছেগি। এখন যাই অইছে এইগুলো কাটিয়া বাড়িত নিরাম। যদি সব ধান নষ্ট অইযায় ছেলে মেয়ে পরিবার নিয়া বিষ খাইয়া মরমু।’
শাল্লার বাঘার হাওরের কৃষক প্রশান্ত দাশ বলেন, ‘২০ কেয়ার জমিত ধান করছিলাম। আর ৫-৬ দিন আছিল ধানটা কাটি লাওয়ার সময় অইগেছিল। কিন্তু এই হঠাৎ করি নদী বাড়িয়া আমরারে মারি দিসে। ২০১৭ সালের পরে আমি নদীত ইলান পানি বাড়তে দেখছি না। আমার সব ধান পানির তলে। আমি গিয়া তুলরাম না কারণ তুলিয়া কিতা লাভ অইতো।’
সুনামগঞ্জের হাওর এরিয়া আপলিফমেন্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন, হাওরের কাজ এ বছর খুব বাজে হয়েছে, যা এখনো শেষ হয়নি। পুরোনো বাঁধকে দুর্বল করে নতুন করে করা হচ্ছে। যা কোন সময় হাওরের জন্য শুভ নয়। হাওরকে হরিলুট এর জায়গা বানিয়ে ফেলেছেন কর্মকর্তারা। সেখানে পিআইসি প্রথাকে খারাপভাবে উপস্থাপন করার জন্য প্রশাসনের লোকেরা টাকার মাধ্যমে পিআইসি গঠন করেছে, যার জন্য কৃষকরা ভোগান্তিতে পড়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘সুনামগঞ্জে আরও ৩-৪ দিন টানা বৃষ্টি হলে ২০১৭ সালের পুনরাবৃত্তি হবে। কৃষকের সকল ফসল তলিয়ে যাবে। তারপর প্রশাসন কী উত্তর দেয় সেটিই আমরা দেখবো।’
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশমির রেজা বলেন, ‘এ বছর হাওরের বাঁধগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, আগাম বন্যার শঙ্কা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর বেশিই ছিল। তবে বাঁধ নির্মাণে অনেক ত্রুটি আছে। অনেক জায়গায় বাঁধ ফেটে গেছে। মাটি সরে যাচ্ছে, সেগুলো দ্রুত মেরামত করতে হবে। ধান কাটার আরও ১৫ দিন বাকি আছে। তবে দেড় মাস আমাদের এ বাঁধগুলো টিকিয়ে রাখতে হবে।’
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বিজন সেন রায় বলেন, ‘হাওরে হরিলুট চলতেছে, কৃষকের স্বপ্ন নিয়ে এক শ্রেণির মানুষ লুটের রাজত্ব করছে। অনিয়ম করছে। আমরা বসে থাকবো না। আর একটি বাঁধের ক্ষতি হলে আমরা আন্দোলন শুরু করবো।’
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘গত দুই দিনের চেয়ে আজকের দিনটা ভালো। সকালের দিকে কিছু পানি কমতে শুরু করলেও এখন পর্যন্ত তা স্থিতিশীল রয়েছে। তবে আশা করি আর বৃষ্টিপাত না হলে কৃষকরা ঘরে দ্রুতই ফসল তুলতে পারবেন। এছাড়া যে বাঁধে অনিয়ম পাওয়া গেছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বাঁধের কাজ সব শেষ। তবে যে বাঁধগুলো ক্রুটিপূর্ণ এবং সংস্কার প্রয়োজন সেগুলোর কাজ করা হচ্ছে। আমরা চাই না সুনামগঞ্জে আরও একটি ফসলও নষ্ট হোক।’