logo
আপডেট : ৬ এপ্রিল, ২০২২ ০৯:১৪
ওয়াশিংটনে মোমেন-ব্লিংকেন বৈঠক
আরো ৫০ বছর যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে চায় বাংলাদেশ
ঢাকা-ওয়াশিংটন নিরাপত্তা সংলাপ আজ
তরিকুল ইসলাম

আরো ৫০ বছর যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে চায় বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রকে আরো ৫০ বছর উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পাশে চেয়েছে বাংলাদেশ। বারডেম ইস্যু হিসেবে র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে যুক্তরাষ্ট্রের এ-সংক্রান্ত কমিটির সঙ্গে কাজ করে তাদের সন্তুষ্ট রাখতে হবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতি আস্থার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।

এদিকে ওয়াশিংটনে আজ বুধবার বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিরাপত্তা সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। সংলাপে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন অস্ত্র বিষয়ক গোপন তথ্য বিনিময় ও সুরক্ষার চুক্তি (জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট-জিসোমিয়া) নিয়ে বিস্তর আলোচনা হবে। এছাড়া অস্ত্র কেনাকাটা বিষয়ক চুক্তি (একুইজিশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট-আকসা) নিয়েও আলোচনা হবে। প্রতিরক্ষা বিষয়ক এ দুটি চুক্তির মাধ্যেমে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের পরবর্তী ধাপ এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের তরফে এর আগেই পরিষ্কার করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০০২ সালে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আকসা চুক্তি সই করে যুক্তরাষ্ট্র। একই বছর ভারতের সঙ্গে জিসোমিয়া চুক্তি সই করে দেশটি। এবার দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে এ দুটি চুক্তিই সইয়ের আগ্রহ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, আকসা ও জিসোমিয়া নিয়ে বাংলাদেশের আলোচনা চলছে। খুব দ্রুতই যে চূড়ান্ত কিছু হতে যাচ্ছে বিষয়টি এমনও নয়। নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সংলাপে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হবে। তবে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত সংলাপে হবে সেটি বলা যায় না। এজন্য আরো সময়ের প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ১১টায় ওয়াশিংটন ডিসিতে উভয় দেশের মধ্যে শুরু হয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। দীর্ঘসময় ধরে চলা এ বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন।

বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্র আবদুল মোমেন গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের উন্নতি এবং সম্ভাবনা তুলে ধরে বলেন, আমরা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে একটা বড় অর্থনীতির দেশ হব। যুক্তরাষ্ট্র গত ৫০ বছর আমাদের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে ছিল এবং আমরা চাই আরো ৫০ বছর আমাদের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে থাকুক। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো জোরদারে শেখ হাসিনার সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলেও উল্লেখ করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠককে ফলপ্রসূ হিসেবে অভিহিত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেন, আগামী ৫০ বছরে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার করার বিষয়ে আমরা আশাব্যঞ্জক আলোচনা করেছি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সুযোগগুলো গ্রহণ করে যাতে আরো বেশি করে তাদের বিনিয়োগ করে, সেই খাতগুলোও তুলে ধরেন ড. মোমেন। বর্তমানে বাংলাদেশে দেশটির বিনিয়োগের ৯০ শতাংশ এনার্জি অ্যান্ড ইলেকট্রনিক সেক্টরে। বাংলাদেশ চায় ফার্মাসিউটিক্যালস, আইটি খাতসহ আরো অন্যান্য খাতে এগিয়ে আসুক দেশটি। তৈরি পোশাক খাতে ট্যারিফ তুলে নিতেও বৈঠকে অনুরোধ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের উন্নতিতেও কাজ করবে এবং ৭ কর্মকর্তাসহ বাহিনীটির ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে দেশটির এ-সংক্রান্ত কমিটির সঙ্গে কাজ করে সন্তুষ্ট রাখতে হবে বাংলাদেশকে। বৈঠক শেষে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নিজের বক্তব্য তুলে ধরতে সাংবাদিকদের এক ভিডিও বার্তায় ড. মোমেন বলেন, র‌্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেনকে বলেছি, র‌্যাব একটি ভালো প্রতিষ্ঠান, তাদের কারণে দেশে সন্ত্রাস কমেছে এবং র‌্যাবের জবাবদিহি আছে, তোমরা তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে আমরা খুশি হব। ব্লিংকেন আমাকে বললেন, এটার একটা প্রসেস আছে। আমি বললাম, যে গত চার মাসে কেউ মারা যায়নি। উনি বললেন, এটা আমি জানি। এ বিষয়ে উন্নতি করতে আমরা একসঙ্গে কাজ করব।

ড. মোমেন বলেন, র‌্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে একটু সময় লাগবে। কেননা এটা যুক্তরাষ্ট্রের নির্দিষ্ট একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে। এ-সংক্রান্ত কমিটির সঙ্গে কাজ করে তাদের খুশি করতে হবে, কমিটির চেয়ারম্যান-মেম্বার সবাইকে খুশি করতে হবে। তিনি বলেন, শ্রম অধিকার বিষয়ে বাংলাদেশে যেসব উন্নতি করেছে সেসব বিষয় সম্পর্কে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছি। তাদের বলেছি, আমরা আইএলও এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে পরামর্শ করে শ্রম অধিকার খাতের উন্নয়ন করছি। শ্রমিক অধিকারসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে যে দুর্বলতা আছে, তা কমপ্লিট রোডম্যাপ করে ঢাকা-ওয়াশিংটন সংলাপের মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছি। বৈঠক ভ্যাকসিন, অর্থনীতি, বিনিয়োগ, জলবায়ু, শ্রমিক অধিকার, দুই দেশের মধ্যে বিমান চলাচল, বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরীকে ফেরত আনা, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

মার্কিন উদ্যোগ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল প্রসঙ্গে ড. মোমেন বলেন, আমরা তাদের বলেছি, অবাধ, উন্মুক্ত, অন্তর্মুখী এবং নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল চাই। ওয়াশিংটন ডিসিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সব দেশের গণতন্ত্র সমান নয় বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন। বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আস্থা আছে। উভয় দেশের নীতিগত অবস্থান ও রাজনৈতিক বোঝাপড়াও বেশ ভালো। তাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে উভয় দেশের সম্পর্ক আরো ভালো হওয়ার সুযোগ রয়েছে। একেক দেশের গণতন্ত্রর মাপকাঠিও একেক রকম উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা স্বাধীন এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। আমাদের হিউম্যান রাইটস ভ্যালুস আছে। গত কয়েক বছরে আমাদের দেশের গণতন্ত্র অত্যন্ত সুষ্ঠু রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস, মানব পাচার, মাদকসহ আরো যে বিষয়গুলো কমিয়ে আনতে চায়, আমরাও সেগুলো কমিয়ে আনতে চাই। এমনকি তারা গণতন্ত্রের কথা বলে, আমরাও একই কথা বলি।

বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাসী। রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়ায় তা ব্যাঘাত হচ্ছে। আমার এ সফরে এ বিষয়ে আমি আলোচনা তুলব। এছাড়া র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টিও বলব। ওয়াশিংটনের ওই বৈঠক সম্পর্কে গতকাল মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বৈঠকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থনদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতা এবং খ্যাতিমান ব্যক্তিদের ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশ কর্তৃক বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রদান সংক্রান্ত রেজুলেশনের পক্ষে ১৬ বারের মধ্যে ১৫ বারই সমর্থন দেওয়ার বিষয়ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

ড. মোমেন এ সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের অংশীদারত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা, আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের ৬ কোটির বেশি ভ্যাকসিন দিয়ে সহযোগিতা প্রদানের কথাও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। এছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি এবং রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় এককভাবে বৃহত্তম সহায়তা প্রদানের কথা তুলে ধরেন। ড. মোমেন বৈঠকে বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়ন ও অগ্রগতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ, নারীর ক্ষমতায়ন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উল্লেখ করেন এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের এ অগ্রযাত্রায় পাশে থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে ধন্যবাদ জানান।

বৈঠক নিয়ে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের ইস্যু করা বার্তায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন বলেন, এটা খুব আনন্দের বিষয়, আজ (মঙ্গলবার) এখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনকে পেয়েছি এবং যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের অংশীদারত্ব আরো জোরদারের লক্ষ্যে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারব। আমরা আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করছি। আমাদের ৫০ বছরের এ পথচলার কথা ভাবলে আমরা আমাদের অংশীদারত্ব শক্তিশালী করতে আগামী ৫০ বছর একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যাশা করি, যেমনটা আমি বলছিলাম। বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় অন্য দেশগুলোকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশ ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে অসাধারণ মানবতা ও উদারতা দেখাচ্ছে। আমরা সে কারণে এবং বিশ্বজুড়ে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষার অন্যতম প্রবল সমর্থক ও এমন আরো অনেক কাজের জন্য বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ।

মুখপাত্র নেড প্রাইসের বিবৃতিতে বলা হয়, বৈঠকে তারা দুই দেশের সম্পর্কের অসাধারণ ও ব্যতিক্রমী অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং গত অর্ধশতক ধরে আমাদের দুই দেশ যেভাবে পরস্পরকে সহযোগিতা করেছে তার ওপর আলোকপাত করেছেন। আলোচনায় ফুলব্রাইট বিনিময় কার্যক্রমসহ দুই দেশের মানুষের সঙ্গে মানুষের ক্রমবর্ধমান বন্ধনের বিষয়টিও উঠে এসেছে। এছাড়া সেক্রেটারি ব্লিংকেন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন জলবায়ু সংকট মোকাবিলা ও গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের চাহিদা মেটাতে চলমান সহযোগিতা এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে আঞ্চলিক নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন। সেক্রেটারি ব্লিংকেন নিরাপদ ও সমৃদ্ধশালী গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি হিসেবে মানবাধিকার রক্ষা, আইনের শাসন এবং স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের গুরুত্বের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।