দেশের বেশিরভাগ চরে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সঠিক বিপণন ব্যবস্থা নেই। এ কারণে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না চরের কৃষকরা। আর তাই তো বছরের পর বছর কম দামে পণ্য বিক্রি করে দরিদ্রতা দূর করতে পারছেন না তারা। তবে এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে চরের মানুষদের স্বাবলম্বী করতে কাজ করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) ও এর আওতাভুক্ত চর উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্র (সিডিআরসি)।
বর্তমানে দেশের ১০ জেলার চরাঞ্চলে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকার এমফোরসি প্রকল্পের সহায়তায় উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে। এতে ভাগ্য খুলছে কৃষকদের।
মূলত ব্রহ্মপুত্র, যমুনা আর তিস্তার চরে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মান ভালো হওয়ায় এখন আগ্রহ বেড়েছে কোম্পানিগুলোর। ন্যায্যমূল্যে পণ্য ক্রয়ের পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া ওই জনগোষ্ঠীর গবাদিপশু পালনে প্রযুক্তিগত সুবিধা ও উচ্চ ফলনের জন্য সরবরাহ করা হচ্ছে মানসম্মত বীজ।
কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওইসব চরবাসীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকার এমফোরসি প্রকল্পের আওতায় কাজ শুরু করার পর ফসলের উৎপাদন বেড়েছে গড়ে দুই থেকে তিন গুণ পর্যন্ত।
জানা গেছে, চরাঞ্চলে দরিদ্রবান্ধব বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকার উত্তরাঞ্চলের রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল ও জামালপুর জেলার ৩২টি উপজেলায় কাজ শুরু করে।
পাঁচ বছরের এই কাজে দুই দেশের প্রায় ৯৩ কোটি টাকা খরচ হয়। প্রথম ধাপে এ কাজে ধান, ভুট্টা, পাট, পেঁয়াজ, সরিষা, চিনাবাদাম, মরিচ আর শাক-সবজি চাষের পাশাপাশি গবাদিপশু পালনে এক লাখ ২৪ হাজার পরিবারকে সহযোগিতা করে বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, (আরডিএ) এবং সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান সুইসকন্ট্যাক্ট।
এতে গাইবান্ধার সদর উপজেলার কামারজানী ইউনিয়নের কুন্দারপাড়া চরে শিরীনা বেগম, শাহানা আক্তার ও কৃষক ইউনুস আলীসহ অনেকেই এখন আর্থিকভাবে সচ্ছল। চাষাবাদের পাশাপাশি গরু মোটাতাজাকরণ, ছাগলের খামার ও দেশি জাতের মুরগি পালনে বড় অংকের লাভ গুনছে এসব পিছিয়ে পড়া মানুষরা।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের ধুতিচেরা চরের কৃষক তারিফ উদ্দিন মিয়াজি জানান, এমফোরসি প্রকল্পের সহায়তায় গত কয়েক বছরে চরে ভুট্টা, মরিচ ও পাটের চাষ বেড়েছে। এছাড়াও উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষাবাদে ঝুঁকছে কৃষকরা। আর ব্যবসায়ীরা নিজ উদ্যোগে চর থেকে পণ্য কেনায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, বর্তমানে এমফোরসি প্রকল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে গরু ও ছাগলের খামার গড়ে তুলেছে কৃষকরা।
আফতাব বহুমুখি ফার্ম লিমিটেডের অপারেটিভ ডিরেক্টর কাজী শিব্বির আহমেদ জানান, বেশিরভাগ চরে কৃষকরা এখন মরিচ, চিনাবাদাম এবং ভুট্টা চাষ করছেন। আর এসব ফসল যেকোনো সমতল এলাকার চেয়ে অনেক ভালো। এছাড়া আগের চেয়ে এখন ফলন বেড়েছে কয়েক গুণ। আর এ কারণে চর থেকে সরাসরি পণ্য কিনতে কোম্পানিগুলো এখন বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে।
তিনি আরো জানান, কোম্পানিগুলো শুধু পণ্যই কিনছে না, গবাদিপশু পালনের জন্য ন্যায্যমূল্যে সরবরাহ করছে ফিড ও বীজ। আফতাব, এসিআই কোম্পানির পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ও স্থানীয় ছোট-বড় বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা চরের পণ্য কিনতে অগ্রিম টাকা দিচ্ছে। এর ফলে চরের মানুষের দরিদ্রতা কমেছে। একই সাথে জীবনমানের উন্নয়ন হচ্ছে।
পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, বগুড়া’র যুগ্ম পরিচালক ও মেকিং মার্কেটস ওয়ার্ক ফর দি চরসের (এমফোরসি) প্রকল্প পরিচালক ড. মো. আব্দুল মজিদ প্রামাণিক জানান, প্রকল্প শুরুর পর চরে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়েছে ফসলভেদে ২৫-৩০ শতাংশ। আর ফলন বেড়েছে গড়ে ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত। বিভিন্ন ফসলভেদে চাষের নানা পদ্ধতি তথা প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারায় কৃষকরা ভালো ফলন ও দাম বেশি পাচ্ছে।
বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) খলিল আহমদ জানান, চরাঞ্চলে যেসব ফসল উৎপাদন করা হয়, তা খুব কম মূল্যে বিক্রি হওয়ায় ওইসব মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আর এ বিবেচনায় এমফোরসি প্রকল্পের সহায়তায় চরের পণ্য কিনতে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছে। যাতে তারা সরাসরি চর থেকে এসব পণ্য কিনলে চাষিরা ভালো দাম পায়। ইতোমধ্যে এসিআই অনেক আগে থেকে ভুট্টা কিনছে। আফতাব গ্রুপ পণ্য কেনা শুরু করেছে।’