নিজেদের মধ্যে নানা ইস্যুতে টানাপোড়েন চললেও আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জোটের কলেবর বাড়াতে চায় বাম গণতান্ত্রিক জোট। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে ঐক্যের পক্ষে একমত নন অনেক বাম দলের নেতাই। তারা বলছেন, নয় দলের সমন্বয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের বাইরে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে মিত্র বানাতে চায় তারা। এজন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানান জোটের বেশ কয়েকজন নেতা।
তারা জানান, আ স ম রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডি, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, বি চৌধুরীর বিকল্পধারাসহ জোটের বাইরে থাকা বাম দলগুলোকে আগে কাছে ডাকার পরিকল্পনা রয়েছে। এরপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে আরো কিছু দলকে বৃহত্তর এই প্ল্যাটফরমে যুক্ত করার চিন্তা করা হচ্ছে। ঐক্যফ্রন্ট সক্রিয় না থাকলেও প্রস্তাব এলে এই জোটের সঙ্গে এক হয়ে পথ চলতে আপত্তি নেই জোটের অনেক নেতার।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্তত চারজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে কথা হয় বলে জানা গেছে। আপাতত তারা বর্তমান জোটকে নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান। জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়কে সামনে রেখে দেওয়া হবে রাজনৈতিক কর্মসূচি। ইতোমধ্যে জোটের পক্ষ থেকে দেশব্যাপী হরতালও পালন করা হয়েছে। যা বিরোধী দল বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টির পক্ষে সম্ভব হয়নি। এভাবেই সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে চান জোট নেতারা। এতে ভোটের ফলাফল নিজেদের পক্ষে আসবে এমন চিন্তাও করছেন বাম জোটের কেউ কেউ।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চলতি বছরের শেষ দিকে জোটের রাজনৈতিক মেরুকরণ নতুন মাত্রা পাবে। কিছু জোট ভাঙতে পারে। আবার নতুন করে কিছু রাজনৈতিক জোটের যাত্রাও শুরু হতে পারে। তখন নতুন জোটের পরিধি বাড়ানোর বিষয়ে তৎপরতা বাড়বে। সেইসঙ্গে ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন চলছে।
ইতোমধ্যে শরিফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বোধীন জাসদের একাংশ ১৪ দল থেকে বেরিয়ে গেছে। সামনের দিনে যদি আরো কিছু দল আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করে তবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে চায় বাম দলগুলো। যদিও বাম গণতান্ত্রিক জোটে থাকা শরিকদের মধ্যে মাত্র তিনটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন রয়েছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই বাম গণতান্ত্রিক জোট গঠিত হয়। শুরুতে জোটে আটটি দল ছিল। দলগুলো হলো সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লিগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে একটা অংশ বেরিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্ক্সবাদী) নামে নতুন দল করে। এই দলটিও নতুন করে বাম জোটে যুক্ত হয়। জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে কেবল তিনটির সিপিবি, বাসদ ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন রয়েছে। ১৯৯৬ সালের পর এই জোটের শরিক কোনো দল থেকে কেউ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেননি। সর্বশেষ ১৯৯১ সালে সিপিবির পাঁচজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল।
জোটের নেতারা বলছেন, লুটপাটতন্ত্র, গণতন্ত্রহীনতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন। এসবের বিরুদ্ধে যারা আছে, তাদের সবার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হতে পারে।
বাম গণতান্ত্রিক জোট মনে করে, দেশের রাজনীতিতে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় সমমনাদের নিয়ে বড় ঐক্য প্রয়োজন। তারা মনে করেন, রাজপথ থেকেই বড় ঐক্য গড়ে উঠতে পারে। এ জন্য সমমনাদের রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হতে আহবান জানাচ্ছেন তারা।
প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ও জোটের তুলনায় সাংগঠনিক শক্তি সামর্থ্য অনেক কম হলেও বাম জোট বা জোটের শরিক দলগুলো করোনার মধ্যেও বিভিন্ন ইস্যুতে নানা কর্মসূচি পালন করেছে। জোটের নেতারা মনে করছেন, দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির দাপট আবার বাড়ছে। এর পেছনে সরকারের প্রশ্রয় রয়েছে। এটি থামাতে বাম প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের ঐক্য প্রয়োজন। এ বিষয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে জোটটি।
সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দেশ শাসনের নবসংস্করণ অনেক দেখেছে মানুষ। তাই বিকল্প শক্তি হতে হবে। আর সে জন্য বাম শক্তি এখনো তৈরি হয়নি। প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে, কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে। আমরা চাই বৃহত্তর ঐক্য। মানুষ সব দলের শাসন দেখেছে। আমরা দেখিয়ে দিতে চাই ভোট পেয়ে সরকার গঠন করলে সবাই নিরাপদে থাকবেন। দেশে কোনো অশান্তি হবে না। গরিব মানুষদের বিপদদের মুখে পড়তে হবে না।
বাম জোট গঠনের পর থেকেই তিন মাসের ব্যবধানে একজন করে নতুন সমন্বয়ক নির্বাচিত করে আসছে। সর্বশেষ এ পদে দায়িত্বে আছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, আমরা সব বাম দলগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে পথ চলতে চাই। দেশের মানুষকে দেখাতে চাই বিগত সরকারগুলো গরিবের কষ্ট কম বোঝায় তাদের চলতে কষ্ট হয়েছে। তাই আমরা সব সময় অসহায় মানুষের পক্ষে কাজ করব।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন থেকেই তা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে বাম জোট। এটিকে ‘ভোট ডাকাতির’ নির্বাচন বলছে তারা। এ নির্বাচন বাতিল করে নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আরো বেগবান করতে চায় জোট।
বাম জোটের নেতারা বলছেন, করোনাকালে দুর্নীতি, ধর্ষণ, স্বাস্থ্যব্যবস্থার নাজুক দশা নিয়ে করোনার মধ্যেও কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন তারা। ব্যাপক মানুষকে আন্দোলনে যুক্ত করাই এখন তাদের লক্ষ্য। নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কার চায় তারা। জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু করার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছে কয়েক বছর ধরে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী বলেন, বর্তমান স্বৈরাচারবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর শক্তি গড়ে তুলতে জোট প্রসারিত করার চেষ্টা আছে। তাই সবাইকে সংগ্রামে নামতে হবে। সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জোটের সমীকরণ তৈরি হতে পারে। জোট না যুগপৎ হবে, আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তা ঠিক হবে।
সিপিবি সদ্য নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমরা জোটের পরিধি বাড়াতে চাই এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যার তার সঙ্গে আমাদের ঐক্য হবে না। সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একসঙ্গে পথ চলা হতে পারে। এক্ষেত্রে সামনে কোন কোন দলের সঙ্গে আলোচনা হবে এখনই চূড়ান্ত হয়নি। তবে এসব বিষয় নিয়ে আমরা ভাবছি। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিও জোটের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।