logo
আপডেট : ৭ এপ্রিল, ২০২২ ১১:১১
শিউলির জীবনজুড়ে শুধুই অন্ধকার
সুজন মোহন্ত, কুড়িগ্রাম

শিউলির জীবনজুড়ে শুধুই অন্ধকার

প্রতিবন্ধী শিউলি ও তার সন্তানরা

একজন নবজাতক জন্মের পর পৃথিবীর আলো দেখবে এটা খুবই স্বাভাবিক। সেই আলোমাখা রোদের পরশ নিয়ে ধীরে ধীরে বড় হয়ে এক সময় সে সমাজকে আলোকিত করবে। ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝে নিজেকে সাজাবে আপন গতিতে। এভাবে একটা সুন্দর জীবন গড়তে অবিচল চেষ্টা আর স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চায় সবাই। কিন্তু জন্মের পর যাদের চোখে আলো ফোটে না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজের অবহেলিত জীবন নিয়ে তাদের বাঁচতে হয়।

এমনই একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নারী শিউলি বেগম (৩৩)। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের সোবনদহ গ্রামে নানা ওসমান আলীর বাড়িতে বসবাস করেন তিনি। কিন্তু তার জীবনজুড়ে শুধুই অন্ধকার।

জানা গেছে, জন্মান্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন শিউলি বেগম। জন্মের পরপরই বাবা তাদের ছেড়ে চলে যান অন্যত্র। মা অতিকষ্টে ভিক্ষাবৃত্তি করে বড় করেন দৃষ্টিহীন এই শিউলিকে। স্বামী পরিত্যক্তা শিউলি এখন থাকেন নানা বাড়িতে। এক ছেলে জুয়েল (১০), মেয়ে জুঁই (৬) ও বৃদ্ধা মা ফিরোজাকে নিয়ে তার অভাবের সংসার। শিউলির কোনো উপার্জন না থাকায় সরকারের দেওয়া ভাতার টাকাই তার ভরসা। এই টাকা দিয়ে নিত্যদিন খেয়ে না খেয়ে পরিবারের তিন সদস্যকে নিয়ে চরম কষ্টে দিন অতিবাহিত করছেন তিনি।

ভূমিহীন এই পরিবারটির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩২-৩৩ বছর আগে দিনমজুর নানা ওসমানের বাড়ি সোবনদহ গ্রামে জন্ম হয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিউলির। ১৫ বছর বয়সে পাশের গ্রামে শিউলির বিয়েও দেন মা।
সুখে-শান্তিতে চলছিল শিউলির সংসার। দীর্ঘ ১০ বছর সংসার জীবনে এক ছেলে, এক মেয়ের মা হন শিউলি। পরে স্বামী শাহ আলম শিউলিকে ছেড়ে দেন। উপায় না পেয়ে অবশেষে নানা বাড়িতে বৃদ্ধা মায়ের কাছে চলে আসেন তিনি। ছেলেমেয়েকে বাঁচাতে মায়ের সহযোগিতায় শুরু করেন ভিক্ষাবৃত্তি। ভিক্ষাবৃত্তি করেই কোনো রকমে চলছিল তাদের অভাব-অনটনের সংসার। জমিয়েছিলেন কিছু টাকাও।

তবে গত তিন-চার বছর আগে শিউলি আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। বিয়ে করেন সদরের ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের বাবু নামে এক যুবককে। স্বপ্ন ছিল এই দ্বিতীয় বিয়ে করে সুখে-শান্তিতে বাকি জীবন কাটবে তার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর আশা ভেঙে চুরমার করেন দ্বিতীয় স্বামী বাবু। বিয়ের কিছু দিন পর শিউলির কষ্টার্জিত জমানো টাকা নিয়ে উধাও হয় স্বামী বাবু মিয়া। পরে তারা জানতে পারেন বিয়েটিও ছিল ভুয়া। অন্ধ শিউলির জীবনে আবার শুরু হয় হতাশা আর ঘোর অন্ধকার। সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ভাতা পেলেও তা পরিবারের চার সদস্যের জন্য অতি সামান্য।

দৃষ্টিহীন শিউলি বলেন, ‘আমার জন্ম হয় নানা বাড়িতে। জন্মের পর আমি আমার বাবাকেও দেখি নাই, সূর্যের আলো যে কেমন, তাও জানি না। নিজের কোনো জমি নাই। থাকি নানার বাড়িতে। কি অপরাধ করেছি আল্লাহ আমাকে এত কষ্ট দিল কেন? আগে আমার মায়ের সহযোগিতায় ভিক্ষা করতাম। এখন মা চলতে পারে না। তাই আর ভিক্ষা করতে পারছি না। কোনো কোনো দিন না খেয়েও থাকতে হচ্ছে আমাদের। এই অবস্থায় কোথায় যাব, কী করব ভেবে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছি না।’

স্থানীয় বাসিন্দা আয়শা বলেন, ‘শিউলি খুবই কষ্টে জীবনযাপন করছে। কারণ সে অন্ধ মানুষ। কাছ থেকে দেখেছি এদের দুঃখের শেষ নেই। কেউ যদি এদের সহযোগিতা করত, তা হলে এদের কষ্ট কিছুটা কমত।’
ঘোগাদহ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক সরকার বলেন, ‘তারা অত্যন্ত গরিব।
পরিবারে আয় করার মতো কেউ নাই। আমি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিউলিকে ভালোভাবেই চিনি। তার নিজের কোনো জায়গাজমিও নেই। আমি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি, সরকারিভাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া ছাড়াও তাদের স্পেশালভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করব।’