logo
আপডেট : ৮ এপ্রিল, ২০২২ ১৩:২২
ভাবনা-দুর্ভাবনা: হাওরাঞ্চলের কৃষক, হাওরের ফসল
নিজস্ব প্রতিবেদক

ভাবনা-দুর্ভাবনা: হাওরাঞ্চলের কৃষক, হাওরের ফসল

পাহাড়ি ঢলে হাওর রক্ষা বাঁধ প্রতিবছর কেন ভেঙে যায়। কোটি কোটি টাকা খরচা করেও কি বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়?

বুকভরা আশা, চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে সোনার ফসল ঘরে তুলবার দিনক্ষণ গুনছেন হাওরবাসী। হাওরবাসী তাদের একমাত্র অবলম্বন ‘বোরো’ ফসলটি ঠিকঠাক মতো ঘরে তুলে আনতে পারবে তো? দিন যত ঘনিয়ে আসছে, বাড়ছে তত আতঙ্ক। দিনভর যে ফসল নিয়ে স্বপ্ন বুনছেন কৃষক- রাত হলে সেই স্বপ্ন যেন দুঃস্বপ্নের হাতছানি দিয়ে ডাকছে! হাওরের বাঁধগুলোর কাজ কি ঠিকঠাক মতো হয়েছে? নাকি এতটুকু পানির তোড়েই আবার ভেসে যাবে হাওরবাসীর স্বপ্ন! এমন অজানা আশঙ্কা আমার মতো হাওরপ্রেমীদের মনেও। কেন বাঁধগুলো সঠিক সময়ে এবং স্থায়ীভাবে বাঁধা হয় না? কেন, কীভাবে দুর্নীতিবাজ ইঁদুরেরা বাঁধের টাকা খেয়ে খেয়ে হুলো বিড়াল হচ্ছে? বছর বছর এই লুটপাট আর কতকাল? ২০১৭ সালের এপ্রিলে হাওর ডুবতে শুরু করলেও নির্বিকার ছিল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, হাওর ও জলাশয় উন্নয়ন অধিদপ্তর। তখন নেত্রকোনার আঞ্চলিক ভাষায় ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস হৃদয় কেড়েছিল-
‘গ্রাম থাইক্ক্যা স্বজনরা ফোন করতাছে, চৈত মাসে অভাইগ্যা ঢল মানুষের এই বচ্ছরের আশাডারে লণ্ডভণ্ড কইরা দিতাছে। বেকতা মিইল্ল্যা একটাই কতা, একটাই দাবি- আমাগো সরহার (সরকার), লেম্বার (মেম্বার), চেয়ারম্যান আর এমপি আওহাইন খারোওহাইন আমরার সাথে। মোডেতো একটাই বান (বাঁধ)- চরহাজদিয়ার বেরি বান। মোহনগঞ্জ থাইক্কা গাগলাজুর- আইজ ক্যালা আমিলীগ, ক্যালা বিম্পি-এইতা নাই। বেহেই আইজ ঐ বান্দের কানিত সংসার ফাতছে। হেরার চউখ্খে ঘুম নাই। হেরা আমার বাফ হেরাই আমার মা, আমার বাই বইন। বান্দের ফানি একটু চুয়ায় আর দৌওইরা যায়। কেউ মাডি লইয়া কেউ উঁরা লইয়া। পুরা হাওরডাই হেরার সামনে বাড়া ভাত। হে মাবুদ আইজ বাড়া ভাতে পানি ডাল্লা! বউ পোলা এসির তল গুমাইতাছে আমরার তো গুম নাই। কি খবর? কি খবর? সারা রাইত ধইরা ফোন আর ফোন। এই শ্যাষ! সব শ্যাষ!!’


তখনি বলেছি, হায় এই করুন আর্তনাদ- দোহায় তোমার প্রভু, তুমি অন্তত শুনো। ইট-পাথরের এই পাষাণ হৃদয়ে কৃষকের কষ্ট ভাগ করতে হয়তো পারব না; তবে বিধাতার কাছে ফরিয়াদ জানাতে পারবÑ ‘হে দয়ার বিধাতা তুমি দেখো, তোমার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের করুন আহাজারি! তুমি রক্ষা করো, দয়া করো প্রভু- যা মানুষ পারে না, তা শুধু তুমিই পারো।’ আর আমাদের সরকার নির্বিকার থেকো না। দয়া করো পাশে দাঁড়াও- হাওরবাসীর। আজো একই কথা বলছি কারণ, হাওরের ফসল রক্ষায় এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের নীরবতায় মনে প্রশ্ন জাগে- আমরা কি দুর্যোগের জন্য অপেক্ষ করি! দুর্যোগ শুরু হলেই কেন আমাদের টনক নড়ে, কেন আগে নয়?


আমরা জানি, এই হাওরাঞ্চল প্রকৃতিবান্ধব এলাকা। যেখানে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ বা যত্রতত্র পরিবেশ দূষণ হয় না। হাওরের মাছের কি স্বাদ! হাওরের ধানের চালের কি মৌ মৌ সুবাস! টাঙ্গুয়ার হাওরের সুন্দরের লীলাকেতন হয়তো আমাদের স্মৃতিতে অম্লান। কিন্তু হাওরের মানুষের কষ্ট আমরা কতটা বুঝি। এই হাওরে উৎপাদিত মাছ দেশের বিভিন্ন জেলায় এমনকি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। হাওরের উৎপাদিত মাছ ও ধান দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখে। আপনি কি জানেন, আমাদের দেশি জাতের অনেক ধান এখনো হাওরাঞ্চলে উৎপাদিত হয়। আমাদের মনে রাখা দরকার বছরে হাজার লাখ টন ধান উৎপাদন করে দেশের খাদ্য চাহিদা মেটায় এই হাওরবাসী। হাওরাঞ্চলের জলরাশিতে পাওয়া যায় দেশীয় জাতের বিলুপ্তপ্রায় অনেক জাতের মাছ। দেশের আহরিত মাছের শতকরা ২৫ ভাগ হাওরাঞ্চল থেকে আসে। হাওরের জলাবদ্ধ ভূমিতে পাওয়া যায় নল-খাগড়া, হিজল, করচ, ইকরা, জিংলা, বাঁশ এবং প্রচুর বনজসম্পদ। একটা সময় ছিল যখন হাওরের জলমহালের মালিকানা ছিল স্থানীয় জনগণের হাতে। তখন হাট-বাজারে ঢোল পিটিয়ে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্তভাবে মাছ ধরার সুযোগ ছিল। এখন এসব জলমহাল চলে গেল সর্বগ্রাসী রাজনীতিবিদদের হাতে। এখন জেলেরা মাছ ধরবে তো দূরের কথা- গুলির ভয়ে, মরার আতঙ্কে থাকে।


হাওরে কাঁচা-পাকা ধানের শিষগুলো কৃষকের একমুঠো সুখে থাকার আশা যখন অসময়ে পাহাড়ি ঢলে পানির নিচে তলিয়ে যায়- তখন কেমন লাগে? প্রকৃতির কাছে এই অসহায়ত্ব কি যে নিদারুণ কষ্টের তা কি আমরা অনুভব করতে পারি? ২০১৭ সালে অসময়ে অকাল বন্যায় কাঁচা-পাকা ধান সব তলিয়ে যায় পানির ঢলে। যে কৃষকের গোলায় শত শত মণ ধান গড়াগড়ি খায় সেই কৃষকের ঘরে একমুঠো ধান উঠেনি। জলের বানে ডুবে গেছে ধান, তারপর পচা ধানের গ্যাসে মরে গেছে মাছ, সেই মাছ খেয়ে মরেছে হাঁস। আর সে মহামারিতে হাওরের কৃষক-শ্রমিকের জীবনে নেমে আসে চরম দুর্দশা, মহা সর্বনাশ। নিম্নবিত্ত ও দরিদ্ররা কাজের খোঁজে গ্রাম ছেড়ে ছুটে গেছে শহরে। তাদের পরিবারগুলো দেশবাসীর ভালোবাসা-সহযোগিতা এবং সরকারের ত্রাণ সহায়তা নিয়ে কোনো মতে দিনাতিপাত করেছে, করছে। সবচেয়ে সমস্যায় ছিল মধ্যবিত্ত কৃষিনির্ভর পরিবারগুলো। যারা সামাজিক অবস্থানের কারণে, চক্ষু লজ্জায় ত্রাণের সুবিধা না নিতে পেরে গোহালের গরু বেঁচে অথবা ফসল ডুবা ঋণের বোঝার উপরে আবারো ঋণদারি করে দিন পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে। এক কথায়- ২০১৭ সালে শতাব্দীর স্মরণীয় দুর্যোগ নেমে এসেছিল হাওরবাসীর জীবনে। ফসল হারিয়ে সর্বশান্ত কৃষক-জেলে পরিবার ঋণের দায় মাথায় থাকা অবস্থায় আরো নতুন ঋণ নিয়ে মাঠে ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের স্বপ্ন-মায়ার সবটুকু নির্যাস। ফলিয়েছে সোনার ফসল। হাওরের অবাধ প্রান্তরে সবুজ আর সবুজের সমারোহে যেন বাতাসে দোল খাচ্ছে কৃষকের বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে। পাশাপাশি বুকের ভেতরে অজানা শঙ্কা, ভয় ভর করেছে কৃষকের মনে। এবারও কি ফসল ডুবে যাবে!


হাওরপ্রেমী হিসেবে আমি প্রার্থনা করি, হে প্রভু- হে রিজিকের মালিক, তুমি ফিরে তাকাও। আর আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন সোনার ফসল ঘরে তুলবার তৌফিক দাও। হাওরের কৃষকের জন্য এমন প্রার্থনা ছাড়া আর কিছু যেন করার নেই। কারণ কৃষকের পাশে নেই মন্ত্রী, নেই জনপ্রতিনিধি কিংবা সুধী সমাজ। চালের দাম বাড়লে আমরা যারা চিৎকার চেচামেচি করে বাজার গরম করে তুলি- তারা আগেই আসুন প্রার্থনা করি, কৃষক যেন তার সোনার ফসল নিরাপদে ঘরে তুলে আনতে পারেন। তাহলে চালের বাজার কিছুটা হলেও সহনীয় থাকবে। আর আমাদের বাঁকপটু মন্ত্রীরা ঘাটতির অজুহাতে চাল আমদানির নামে অর্থ লুটেপুটে খেতে পারবে না। আর আমাদের মাফিয়া আড়ত ব্যবসায়ীরা দুর্যোগের অজুহাতে চালের দামকে স্বর্ণমূল্যে তুলতে পারবে না। তাদের বোধোদয় হোক। আমরা দেখেছি ২০১৭ সালে হাওরডুবির খেসারত শুধু হাওরবাসীই দেননি- কমবেশি দেশবাসীকেউ দিতে হয়েছে। হাওরের ফসলহানির ঘাটতি পূরণে প্রথমে খাদ্য মন্ত্রণালয়, ত্রাণ মন্ত্রণালয় বিরাট আশার বাণী শোনালেও শেষে তারা ব্যর্থতা প্রমাণ করেছেন। যার খেসারত দিয়েছি আমরা সাধারণ জনগণ। ৩০ টাকার চাল ৫০ টাকায় আর ৪২ টাকার চাল ৬৫ থেকে ৭২ টাকায় কিনে খেতে হয়েছে। এখনো এরই ধারাবাহিকতা চলছে। আর এই টাকা গেছে মাফিয়াদের পকেটে। তাছাড়া হাওরবাসীর দুঃখ তো ছিল অবর্ণনীয়।


মনে প্রশ্ন জাগে, পাহাড়ি ঢলে হাওর রক্ষা বাঁধ প্রতিবছর কেন ভেঙে যায়। কোটি কোটি টাকা খরচা করেও কি বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়? ২৮ হাজার কোটি টাকার ‘হাওর মহাপরিকল্পনা’র সুফল তুলে আনতে হলে দুর্নীতিমুক্ত প্রকল্পের বাস্তবায়ন চাই। ঋণ, কর্জ, লগ্নি আর খেয়ে-না খেয়ে কষ্টার্জিত ফসল তলিয়ে গেলেও কৃষক কিছুই করতে পারেন না। প্রায় প্রতি বছরই তাদের এ রকম দুঃসহ দুর্ভোগ-দুর্ভাবনার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু বাঁধ তৈরি আর সংস্কারের নামে প্রতি বছর বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে নয়ছয় করা হলেও হাওর রক্ষা বাঁধগুলোকে স্থায়ীভাবে গড়ে তোলা হয় না কোন অদৃশ্য কারণে! যারা দুর্নীতি করে, যাদের অবহেলায় এমন জাতীয় অর্থনৈতিক দুর্যোগ নেমে আসে তাদেরকে কেন রাষ্ট্র অপরাধী হিসেবে শাস্তি দেয় না। হাওরবাসীর পক্ষে এবং হাওরের স্থায়ী ও টেকসই উন্নয়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নীরবতা সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। বাঁধভাঙ্গা জলে নিয়ে তাদেরকে ডুবানো উচিত। কারণ জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধি হয়ে জনগণের বেঁচে থাকার অধিকারকে তাচ্ছিল্য করার অধিকার তাদের নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য- হাওরের উন্নয়নে একটি অধিদপ্তর করা হলেও কার্যতঃ তাদের তেমন কোনো ভ‚মিকা বা দায়ভারও নেই। যদিও হাওর এখন সদাশয় সরকারের নেক নজরে রয়েছে। আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহও রয়েছে হাওরবাসীর জীবনমান উন্নয়নে। তারপরও কাজগুলো ঠিকঠাক মতো কেন হয় না- তা দেখার যেন কেউ নেই! আরেকটি দুঃখের বিষয় হলো- হাওরবাসীর শিক্ষিত সন্তানেরা হাওরের উন্নয়নে কোনো একটি ফোরাম বা প্ল্যাটফর্মে একত্র হতে পারেননি। যে কারণে অনেক অনিয়ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছে- সামাজিকভাবে প্রতিবাদের ঝড় না তোলার কারণে। সবশেষে বলব, হাওরের সমস্যাগুলোর সমাধানে সংশ্লিষ্টদের প্রতি রাষ্ট্রের কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেয়া দরকার এবং তা অবশ্যই ফসল ডুবার আগেই।


লেখক: কৃষি-অর্থনীতি বিশ্লেষক, উন্নয়ন গবেষক এবং কলাম লেখক