logo
আপডেট : ৯ এপ্রিল, ২০২২ ১০:২৮
থেমে নেই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা
এমদাদুল হক খান

থেমে নেই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা

ফাইল ছবি

পুরান ঢাকার চকবাজারে শামসুদ্দীন আহমেদ অ্যান্ড সন্স এ দেশের সবচেয়ে পুরোনো বন্দুকের দোকান। কলকাতার ম্যান্টন কোম্পানিতে পুরান ঢাকার ছেলে শামসুদ্দীন আহমেদ গানস্মিথের কাজ করতেন।

ইয়েমেনি স্ত্রী আবেদান্নেসা আর যৌথ পরিবারের সদস্যদের দেশে ফেলে রেখে চাকরিতে মন টেকেনি। ফিরে এসে ১৯১২ সালে ঢাকার চকবাজারে নিজেই শুরু করেন অস্ত্র ব্যবসা।

একনলা-দোনলা বিদেশি বন্দুক বিক্রি করতেন, সেই সঙ্গে মেরামতের কাজটাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন শামসুদ্দীন আহমেদ। খুব দ্রæতই তিনি সমৃদ্ধির দেখা পান। ১৯৪৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিয়মিত দোকানে বসতেন।

দোকানটি যার নামে সেই শামসুদ্দীন আহমেদের নাতি আবরার আহমেদ। তিনি ও তার দুই ভাই ব্যবসাটাকে ধরে রেখেছেন। পরের প্রজন্মের আর আগ্রহ নেই। কেউ অন্য ব্যবসায় ঢুকে গেছে, কেউ চাকরি করছে।

শামসুদ্দীন আহমেদ অ্যান্ড সন্সের অন্যতম স্বত্বাধিকারী আবরার আহমেদ বলছিলেন, ছেলেরা আর চায় না। বন্দুকের ব্যবসার সঙ্গে তিন পুরুষের সম্পর্ক শেষের পথে। বিক্রি নেই, সম্মানও নেই।

অথচ আগে এমন ছিল না।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বন্দুক ব্যবসায়ী বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্রধারীদের করুণার ওপর বৈধ অস্ত্রধারীদের টিকে থাকতে হচ্ছে। অবৈধ অস্ত্রে তো বাজার সয়লাব।

টানাটানি শুধু বৈধ অস্ত্রধারীদের নিয়ে।’ পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) হালনাগাদ বৈধ অস্ত্রের তথ্যভান্ডার ফায়ার আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফএএমএস) সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে এখন বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৪৪ হাজার ১০৪টি, যার মধ্যে ব্যক্তির নামে রয়েছে ৪০ হাজার ৭৭৭টি অস্ত্র।

বাকি অস্ত্রগুলোর লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে একনলা ও দোনলা বন্দুক, শটগান, পিস্তল, রিভলবার ও রাইফেল।

পুলিশ বলছে, বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে কোথাও কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীদের দ্রæত শনাক্ত করার জন্য এই তথ্যভান্ডার তৈরি করা হয়েছে। এসবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের জুলাই থেকে দেশে ছয় শতাধিক থানা এলাকার লাইসেন্সকৃত অস্ত্র এবং এর ব্যবহারকারীদের তথ্য এই তথ্যভান্ডারে যুক্ত করা হয়।

৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৪৪ হাজার ১০৪টি অস্ত্রের লাইসেন্সের তথ্য এতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ হাজার ৭৭৭টি অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে ব্যক্তির নামে। বাকি ৩ হাজার ৩২৭টি অস্ত্র রয়েছে আর্থিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অস্ত্রের লাইসেন্স নেওয়ার তালিকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও রয়েছেন। একজনের নামে একাধিক অস্ত্রের লাইসেন্স থাকার নজিরও আছে।

বিভাগভিত্তিক হিসাব ধরলে সবচেয়ে বেশি অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে ঢাকা বিভাগে, ১১ হাজার ৮৯৮টি। আর সবচেয়ে কম বরিশালে, ২ হাজার ২৪৮টি অস্ত্র।

সারা দেশে লাইসেন্স করা অস্ত্র হারানো, থানায় জমা দেওয়া, লাইসেন্স করা অস্ত্রের বিষয়ে পুলিশের পরিদর্শন ও অস্ত্র খোয়া যাওয়ার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে ৮৪টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। ২৪টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থায়ী বাতিল করা হয়েছে।

বন্দুক ব্যবসায়ীরা জানান, স্বাধীনতার পর থেকেই এই ব্যবসায় উত্থান-পতন ছিল। স্বাধীনতার পর ব্যক্তি খাতে আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ায় আমদানিকারকেরা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে হতো।

জিয়াউর রহমানের সময় পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে পড়ে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে লাইসেন্স দেওয়াই একরকম বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে আবারো আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবসা মোটামুটি স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

বছর পাঁচেক পর আবারো কড়াকড়ি শুরু হয়। তবে ব্যবসায়ীরা মনে করেন, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা ২০১৬ সালের পর তারা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েছেন।

নীতিমালায় ব্যক্তিপর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার অন্যতম শর্ত হলো, আবেদনকারীকে তিন করবছরে ধারাবাহিকভাবে পিস্তল, রিভলবার, রাইফেলের ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিন লাখ টাকা ও শটগানের ক্ষেত্রে এক লাখ টাকা আয়কর দিতে হবে।

বন্দুকের ব্যবহার কমে আসায় অনেকেই অযথা এই টাকাটা আর খরচ করতে চান না। আর্মস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক নাসিরউদ্দীন আহমেদ বলেন, ২০১৬ সালের পর ব্যবসা অর্ধেকে নেমেছে।

সারা দেশের সব জেলায় এমনিতেও বন্দুকের দোকান নেই। দেশের ৮৪টি দোকানের ২২টিই ঢাকায়। সেগুলোও ধুঁকছে। দামও পড়ে গেছে অনেক। যে বন্দুক ৪০ হাজারে বিক্রি হতো, তা এখন ২০ হাজারে বিক্রি হচ্ছে।

প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরোনো দোকান ‘শিকার ও শিকারী’র এই মালিক বলেন, বৈধ অস্ত্র অবৈধ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে-এমন অভিযোগে তাদের সব সময় চাপে রাখা হয়। কিন্তু বন্দুক বা রিভলবারের যিনি মালিক, তার সবচেয়ে নিষ্কলুষ হওয়ার কথা। অন্তত প্রক্রিয়া তাই বলে।

তিনি আরো বলেন, ‘গুলি ছুড়লে ধোঁয়া বের হয়- এমন আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নেই বহুদিন। শিকার নিষিদ্ধ, তার ওপর নিবর্তনমূলক নানা আইনকানুনে বিক্রি কমেছে অনেক। বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে।

আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তরাও সরকারের কাছ থেকে অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছে বলে নানা সময়ে খবর বের হয়েছে। আবার বৈধ অস্ত্রের দোকানের আড়ালেও অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা চালাচ্ছেন কেউ কেউ।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে বৈধ অস্ত্রের দোকান রয়েছে মো. হোসেনের। বৈধ লাইসেন্স নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন অবৈধ অস্ত্রের কারবার।

গত বছরের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড মোড়ের কাছে অভিযান চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল পরিমাণ গুলিসহ হোসেন ও তার তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে পুলিশ জানায়, তিনি চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করেন এসব অবৈধ অস্ত্র।

তার বৈধ অস্ত্রের ব্যবসার আড়ালে এমন অবৈধ কারবার দীর্ঘদিন অজানা ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। এসবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, দিনে কয়টি অস্ত্র-গুলি বিক্রি হয়, তা বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীকে সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করতে হয়।

থানাকে না জানানো পর্যন্ত এই অস্ত্র বা গুলি কে কিনল, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানার সুযোগ নেই। তবে নতুন তথ্যভান্ডার চালু হওয়ায় অস্ত্র বা গুলি বিক্রি করার সঙ্গে সঙ্গেই এসব তথ্য জানা যাবে।

সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নাঞ্চলে অবৈধ অস্ত্রের গুলিতে রাজনৈতিককর্মী, ব্যবসায়ী, সাবেক সেনাকর্মকর্তা, আদিবাসী ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু হওয়ায় অবৈধ অস্ত্র দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, ‘সন্ত্রাসী একটি গোষ্ঠীর কাছে অসংখ্য আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। কারণ অনেক দিন ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। তাই গত ইউপি নির্বাচনেও এসব অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে এবং মানুষ খুন হয়েছে।

সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচয় থাকায় তারা একটি ‘সেফ জোন’ তৈরি করেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান করে এসব আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার না করলে, সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা হতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা করেন।

সন্ত্রাসীরা নিজেদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রেখে তারা বিভিন্নভাবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে প্রচার করে। এতে তাদের অস্ত্রটি ভাড়ায় ব্যবহার বেড়ে যায়, সন্ত্রাসীদের অবৈধ আয়ও বৃদ্ধি পায়।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপ-পুলিশ কমিশনার বলেন, একটি অস্ত্র চার থেকে পাঁচ হাত ঘুরে ব্যবহার হয়। অনেক সময় হত্যাকারী নিজেও জানে না, অস্ত্রটি কার। কারণ কয়েকটি হাত ঘুরে তাকে দিয়ে হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়।

তিনি বলেন, মূলত আগ্নেয়াস্ত্রগুলো তারা সহজে বহন করে কিলিং মিশনে অংশ নিতে পারে। মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে দ্রæত স্থান ত্যাগ করতে পারে। টার্গেটকে নির্দিষ্ট করতে পারে। তাই সন্ত্রাসী গ্রæপগুলো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে।

আন্তর্জাতিকভাবে চোরাচালানের একটি গ্রহণযোগ্য হিসাবও সর্বত্র স্বীকৃত। তা হলো- অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান যা ধরা পড়ে, তা দেশে আসা চোরাচালানের মাত্র ১০ ভাগ। বাকি ৯০ ভাগ ধরা পড়ে না। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ২০২০ সালে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় ১২৪টি মামলা করে।

২০২১ সালে ১১৮টি অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় মামলা করে। তবে এই দুই বছরে রাজধানীতে খুনের ঘটনাই ঘটেছে ২১৯ ও ১৬৬টি। সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনীতির সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ মিলে গেছে।

তাই সন্ত্রাসীরা একটি করিডোর বা সেফ জোন পেয়েছে। রাজনীতিবিদরাও তাদের ব্যবহার করে। আবার সন্ত্রাসীরাও রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করে।

সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে স্বার্থের রাজনীতি যত বৃদ্ধি পাবে, তত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীও বাড়তে থাকবে। তিনি বলেন, সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা হলে এসব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।