logo
আপডেট : ১০ এপ্রিল, ২০২২ ০৮:৫৮
নিষিদ্ধ লেজার লাইট ব্যবহার করছে পুলিশ
রুদ্র মিজান

নিষিদ্ধ লেজার লাইট ব্যবহার করছে পুলিশ

লেজার লাইট। উত্তেজিত বিকিরণের সাহায্যে আলোক বিবর্ধনের অন্য নাম। লেজার রশ্মি অত্যন্ত ঘন সংবদ্ধ একমুখী। এ রশ্মি অনেক পথ অতিক্রম করতে পারে। তা মাত্র কয়েক মাইক্রন চওড়া। এজন্য এতে প্রচণ্ড তাপশক্তি সঞ্চার করা সম্ভব হয়। এর তাপমাত্রা সূর্যপৃষ্ঠ তাপমাত্রার চেয়েও বেশি। ফলে লেজার রশ্মি দিয়ে মানুষের একটা চুলকেও ছিদ্র করা সম্ভব। এ লেজার লাইটের কারণেই বিশ্বে ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। একই কারণে বিঘ্ন ঘটছে বিমান চলাচলে। এ নিয়ে পাইলটদের অভিযোগের শেষ নেই। ইতোমধ্যে সরকারিভাবে সতর্কও করা হয়েছে বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই লেজার লাইট ব্যবহার করছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তাও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে। ট্রাফিকের কর্তারা বলছেন, লিজার লাইট ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপরও অবাধে চলছে এর ব্যবহার। রাজধানীর ঢাকার মোড়ে মোড়ে দেখা গেছে লেজার লাইট ব্যবহারের দৃশ্য। সড়কের লেন বন্ধ ও চালুর ক্ষেত্রে সংকেত দেওয়া হয় এ লেজার লাইট দিয়ে।

 

এক্ষেত্রে লেজার লাইটের আলো প্রায়ই পড়ছে চালকদের চোখে, যা মুহূর্তের মধ্যে দুর্ঘটনার কারণ যেমন হতে পারে, তেমনি চোখ ব্যথা থেকে শুরু করে নানা সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। চিকিৎসকরা বলছেন, লেজার লাইটের কারণে ক্ষতি হতে পারে রেটিনার। চোখ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। গতকাল ইফতারের আগে ও পরে তীব্র যানজট ছিল বাড্ডা-রামপুরা সড়কে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রামপুরা বাজারসংলগ্ন ওয়াপদা রোডের মোড়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। ওই সময়ে ওয়াপদা রোডে দাঁড়িয়ে সবুজ রঙের লেজার লাইট দিয়ে লেনের গাড়িগুলো ছাড়বেন কিনা, বলে সংকেত দিচ্ছেলেন মূল সড়কের রোড ডিভাইডারের কাছে দাঁড়ানো সার্জেন্টকে। একপর্যায়ে সার্জেন্টের ইশারা পেয়ে ওই সড়কের গাড়িগুলো ছাড়েন কনস্টেবল। লেনের গাড়ি ছাড়ার ক্ষেত্রে লেজার লাইট দিয়ে সংকেত দেন তিনি। বেশ কয়েকদিন আগে বিজয় সরণি এলাকায় লেজার লাইটের রশ্মির শিকার হন গাড়িচালক মোস্তফা শিকদার। তিনি জানান, সিগন্যাল ছাড়ার সময় লেজার লাইট ব্যবহার করেন কনস্টেবল। এ সময় লাইটের আলো তার চোখে পড়ে। কিছুক্ষণ পরই চোখ ব্যথা শুরু হয়।

 

যাত্রাবাড়ী এলাকার ট্রাকচালক বিকাশ নারায়ণ জানান, রাতে ট্রাক চালাতে গিয়ে বেশ কয়েকবার লেজার লাইটের আলো পড়েছে চোখে। প্রথমবার সায়েন্সল্যাব এলাকায় যখন তার চোখে লেজার লাইটের আলো পড়ে তাৎক্ষণিক তখন চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। বিকাশ দাবি করেন, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কারণে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ঠিক রাখতে পেরেছিলেন তিনি। লেজার লাইটের কারণে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে বলে মনে করেন এ চালক। শুধু চালকদের ক্ষেত্রে নয়, এ ক্ষতি হতে পারে পথচারীদেরও। ট্রাফিক পুলিশের লেজার লাইট থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না তারাও। এ লাইট বেশি ব্যবহার হচ্ছে রাতে। সন্ধ্যার পর হেঁটে রাস্তা পার হওয়ার সময় অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন লেজার রশ্মিতে। একটি অভিজাত শপিংমলে কাজ করেন ফারাহ। তিনি জানান, সন্ধ্যার পর হেঁটে রাস্তা পার হতে গিয়ে এ পর্যন্ত দেড় মাসে প্রায় দুবার তার চোখে লেজার লাইট পড়েছে। প্রথমবার ঘটনাটি ঘটে সোনারগাঁও মোড়ে। দ্বিতীয়বার মগবাজার মোড়ে। আগেও তার চোখে কিছু সমস্যা ছিল। লেজার লাইট পড়ার পর সমস্যা বাড়তে থাকে। তিনি চোখের ডাক্তার দেখিয়েছেন। এখন চোখে নিয়মিত একটি ড্রপ ব্যবহার করছেন।

 

জানা গেছে, রাজধানীর সব গুরুত্বপূর্ণ মোড়েই ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা যানবাহন নিয়ন্ত্রণে এ লেজার লাইট ব্যবহার করেন। ট্রাফিকের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. সাহেদ আল মাসুদ বলেন, লেজার লাইট ক্ষতিকর বলে এর ব্যবহার কমিয়ে আনা হয়েছে। খুব প্রয়োজন না হলে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে না। চিকিৎসকরা জানান, লেজার লাইটের আলো চোখের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। প্রায় প্রতিদিনই এমন সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে যাচ্ছেন রোগীরা। লেজার লাইটের কারণে অনেকে তাদের দৃষ্টিশক্তি পর্যন্ত হারিয়েছেন। ইস্পাহানী ইসলামিয়া আই ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আরিফ হায়াত খান বলেন, লেজার রশ্মি সরাসরি মানুষের চোখে পড়লে এতে চোখের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। এটি চোখের রেটিনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ম্যাকুলাতে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে। ফলে রোগী ওই চোখে আর দেখতে পান না। পরবর্তীতে অপারেশন ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। খেলনা হিসেবে না বুঝেই এটি অনেকে শিশুদের ব্যবহার করতে দিচ্ছেন, যা মোটেও উচিত নয়।

 

লেজার লাইটের কারণে বিমান চলাচলেও বিঘ্ন ঘটছে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে হঠাৎ কোথা থেকে পাইলটের চোখে এসে পড়ে লেজার বিমের রশ্মি। রশ্মির তীব্রতায় যন্ত্রণা শুরু হয় পাইলটের চোখে। আকাশে আর বেশিক্ষণ থাকেনি বিমানটি। বাধ্য হয়েই অবতরণ করা হয়। এ রকম ঘটনা না ঘটলেও লেজার রশ্মির শিকার হচ্ছেন হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করা বিমানের পাইলটরা। দীর্ঘদিন ধরে ককপিট ফ্লাইট লকের মন্তব্যে এরকম অনেক অভিযোগ জমা পড়েছে। বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো হয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে। ফলে বিমানবন্দর সংলগ্ন আশপাশের এলাকায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে ফোনে খুদেবার্র্তা পাঠানো হয়েছে বার বার। সেইসঙ্গে বিভিন্ন সভা-সেমনিারের মাধ্যমে সচেতন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ বিষয়ে বিমানবন্দর সংলগ্ন পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। অন্যদিকে ট্রাফিক পুলিশ ব্যবহার করছে এ লেজার লাইট।

 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, লেজার লাইটের কারণে চোখের ক্ষতি হয়। যে কারণে এটি ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। লেজার লাইট এখন আর কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। সরকারিভাবে ট্রাফিক পুলিশের কোনো সদস্যকে লেজার লাইট সরবরাহও করা হয়নি। তিনি বলেন, লেজার লাইটের বিকল্প ভাবা হচ্ছে। আপাতত সিগন্যালের ক্ষেত্রে হাত ও সাধারণ লাইট, সিগন্যাল লাইট ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।