logo
আপডেট : ১০ এপ্রিল, ২০২২ ১১:৩৭
বিশ্ব হোমিওপ্যাথি দিবস ও ডা. হ্যানিমেনের জন্মবার্ষিকী
নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশ্ব হোমিওপ্যাথি দিবস ও ডা. হ্যানিমেনের জন্মবার্ষিকী

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক ডা. স্যামুয়েল হ্যানিমেন

আজ রবিবার, বিশ্ব হোমিওপ্যাথি দিবস ২০২২। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক ডা. স্যামুয়েল হ্যানিমেনের ২৬৭তম জন্মবার্ষিকীর দিনে পৃথিবীব্যাপী এ দিবসটি পালন করা হয়। ২০০৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী হ্যানিমেনের জন্মদিন ‘বিশ্ব হোমিওপ্যাথি দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশে যাত্রা শুরু বিশ্ব হোমিওপ্যাথি দিবসের এবং বিশ্ব হোমিওপ্যাথি আন্দোলনে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। আমরা সবাই জানি, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্ম জার্মানিতে। বিজ্ঞানী ডা. স্যামুয়েল হ্যানিমেন এর আবিষ্কারক (১০ এপ্রিল ১৭৫৫ থেকে ২ জুলাই ১৮৪৩ ছিল তার জীবনকাল)। তিনিই প্রথম চিকিৎসাবিজ্ঞানী, যিনি ভেষজ বস্তুকে শক্তিকরণ করে তা সুস্থ মানবদেহে প্রয়োগ করেন, যা তার আগে কোনো বিজ্ঞানী করেননি। তাই আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি বিপ্লবী বিজ্ঞানী হিসেবে। বিপ্লবী এ বিজ্ঞানীর জন্মবার্ষিকী বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। এই দিনে পৃথিবীর আর কোনো বিজ্ঞানীর জন্মদিন এভাবে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় না। ২০০৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী হ্যানিমেনের জন্মদিন পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব হোমিওপ্যাথি দিবস হিসেবে। বিজ্ঞানে কৃত্রিম রোগ আবিষ্কার স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। ১৭৯০ সালে পৃথিবীর মানুষ প্রথম জানতে পারে তার আবিষ্কারের কথা।


হোমিওপ্যাথিকে জানতে হলে, হ্যানিমানকে জানতে হবে। হ্যানিমেনের মূল্য বুঝতে পারলে, হোমিওপ্যাথির মূল্য বোঝা যাবে। আজ ১০ এপ্রিল বিশিষ্ট গবেষক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক ডা. স্যামুয়েল হ্যানিমেনের ২৬৭তম জন্মবার্ষিকী। ডা. স্যামুয়েল হ্যানিমান ১৭৫৫ সালে জার্মানির অন্তর্গত স্যাকস্যানি প্রদশের মিশন নগরীর পটুয়ার ঘরে ১০ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ক্রিস্টিয়ান গড ফ্রাইড এবং মাতার নাম জোহানা ক্রিস্টিয়ানা। তার পিতা মৃৎশিল্পী ছিলেন। অর্থাৎ চীনামাটির বাসনপত্রের গায়ে ছবি আঁকতেন। তার পিতা বাল্যকালে হ্যানিমেনের শিক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু তার প্রতিভার পরিচয় পেয়ে শিক্ষকদের অনুরোধে তিনি তাকে স্কুলে পাঠান। রাত্রে পড়াশোনার জন্য তেল খরচের ভার বহনে পিতা বিরক্ত হতেন। সে জন্য তিনি গোপনে মাটির প্রদ্বীপ জ্বালিয়ে, ঘরের এক কোণে লুকিয়ে পড়াশোনা করতেন। ২০ বছর বয়সেই হ্যানিমেন ল্যাটিন, গ্রিক, হিব্রু বহু ভাষার পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২০ ডলার নিয়ে উচ্চ শিক্ষালাভের আশায় লিপজিগ শহরে গমন করেন। সেখানে দিনের বেলায় লেখাপড়া করতেন এবং রাতের বেলায় ইংরেজি থেকে জার্মান ভাষায় বইপত্র অনুবাদ করতেন। ১৭৭৯ খিস্টাব্দে ২৭ বছর বয়সে এনালার্জেন বিশ^বিদ্যালয় থেকে এমডি উপাধি লাভ করেন। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশাউ নগরের ওষুধ বিক্রেতা কুচলারের কন্যা জোহানা হেনরিয়েটাকে বিয়ে করেন। এর কিছুদিন পূর্বেই তিনি গোমারন ধর্ম মন্দিরের চিকিৎসক নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি এলোপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর আস্থাশীল হয়ে পড়েন। এ সময় তিনি গোমরন ত্যাগ করে ড্রেসডেন সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। শুনতে অবাক লাগলেও সত্য, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক ডা. হ্যানিমান অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসাশাস্ত্রে লেখাপড়া করে ডাক্তার হন এবং অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি অনুযায়ী রোগীদের সেবা প্রদানও করতেন। চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি তিনি গবেষণা ও চিকিৎসাশাস্ত্রের যাবতীয় বইয়ের অনুবাদ করেছেন। গবেষণার একপর্যায়ে তিনি অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় ক্ষতিকর/ সাইড এফেক্টের সন্ধান পান। সাইড এফেক্ট চিহ্নিত করার পরই তিনি অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি চিরদিনের জন্য ত্যাগ করেন। সাইড এফেক্টর কারণ নির্ণয়ে গবেষণার মাধ্যমে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সূত্র আবিষ্কার হয়। হ্যানিমান নিজের দেহে ১৩০টি মেডিসিন প্রুভ করেছিলেন।


পেরুভিয়ান কফি বা সিস্কোকা গাছের বাকল নিয়ে গবেষণা করতে করতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার উদ্ভব হয়। পৃথিবীর কনিষ্ঠতম চিকিৎসা পদ্ধতি হলো হোমিওপ্যাথি। ওষুধ পরীক্ষার পাশাপাশি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার নিয়মনীতি প্রকাশ করেন ১৮১০ সালে। অর্গানন নামে যার পরিচিতি চিকিৎসক মহলে। তার জীবনের শেষপর্যায়ে অর্গানন ষষ্ঠ সংস্করণ সমাপ্ত করেন। বইটির আধুনিক ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালে হ্যানিমান ফাউন্ডেশন, আমেরিকা থেকে। হোমিওপ্যাথির জন্ম জার্মানিতে। বিকাশ ফ্রান্সে, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ব্রিটেনে, ১৮০৫ সালে। প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দি প্যারিস কলেজ অব হোমিওপ্যাথি। ডা. হ্যানিমান সম্পর্কে ড. হুদহুদ মোস্তফার গবেষণা থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়- সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতায় ভীষণভাবে আক্রান্ত আর সত্য চাপা দিতে অত্যন্ত পারদর্শী পশ্চিমাজগৎ যতদিন সম্ভব সম্রাট নেপোলিয়ান, মর্মাডিউক পিকথল, মরিস বোকাইলি, নীল আর্মস্ট্রংসহ আরো অনেক মনীষীর ইসলাম গ্রহণের সংবাদকে চাপা দিয়ে রেখেছিল। সত্য কোনো দিনই হারিয়ে যায় না। কালের প্রবাহে কোনো একদিন প্রকাশিত হয়ই। সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সময় ধরে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিজ্ঞানের আবিষ্কর্তা ডা. স্যামুয়েল হ্যানিমানের ইসলাম গ্রহণের সংবাদটি চাপা পড়ে আছে। ড. হুদহুদ মোস্তফা এক নিবন্ধে লিখেছেন অনেক কথা।


১৯৯৮ সালে লন্ডনে এক সেমিনারে ড. মোস্তফার সাক্ষাৎ ঘটে হ্যানিমানের এক নিকটাত্মীয় ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। তার নাম উইলিয়াম হ্যানিমান। বিজ্ঞানী ডা. হ্যানিমানেরই এক উত্তর পুরুষ তিনি। বিশ্বাসে ক্যাথোলিক খ্রিস্টান। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. হ্যানিমান গবেষণার একপর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন এবং তিনি আমৃত্যু ইসলামি বিশ্বাসেই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। যে কারণে তিনি নিজ জন্মভূমি, স্বজাতি, আত্মীয়-পরিজন ত্যাগ করে দ্বিতীয় স্ত্রী মাদাম ম্যালনিকে নিয়ে প্যারিসে হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মাদাম ম্যালনিও স্বামীর সঙ্গে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এ ঘটনা জানাজানি হয়ে পড়লে হ্যানিমানের স্বজনরা তার প্রতি বিরূপ হয়ে পড়েন। চিরপরিচিত পরিবেশ তার বিরুদ্ধে চলে যায়। শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে সব সহায়-সম্পদ উত্তরাধিকারী আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিলিবণ্টন করে তিনি ইসলামে নবদীক্ষিত স্ত্রী মাদাম ম্যালনিকে নিয়ে প্যারিসের পথে হিজরত করেন। সময়টা ছিল ১৮৩৫ সালের জুন মাস। তারা তাদের জীবদ্দশায় আর কখনো জার্মানিতে ফিরে যাননি। হিজরত নবীদের সুন্নত। ইসলাম গ্রহণের কারণে জার্মান বিজ্ঞানী হ্যানিমানকেও সেই সুন্নতেরই অনুসরণ করতে হয়। উইলিয়াম হ্যানিমান আরো কিছু মহামূল্যবান তথ্য দিয়ে সবাইকে চিরকৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছেন। প্রথমে তিনি ড. মোস্তফাকে বলেছিলেন লন্ডনস্থ হ্যানিমান মিউজিয়ামে যেতে। ঠিকানা : হানেমান মিউজিয়াম পাউইজ প্যালেস, গ্রেট, আরমন্ড স্ট্রিট, লন্ডন, ডবি, উসি। সেখানে হ্যানিমানের ব্যবহৃত বহু জিনিষপত্র আছে, বইপুস্তকের এক বিরাট সংগ্রহ এবং আছে এর মধ্যে মহাগ্রন্থ আল কোরআন। শতাধিক আরবি গ্রন্থ রয়েছে। ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মধ্যে রয়েছে মসজিদের নকশা করা জায়নামাজ, মূল্যবান পাথরের তাসবিহ একটি টার্কিশ টুপি। ব্যবহৃত জায়নামাজের সেজদার চিহ্ন স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়।

ডা. হ্যানিমান ইসলাম গ্রহণ এবং জার্মানি ত্যাগের পর তিনি আর কখনো কোথাও তার পিতা প্রদত্ত নাম ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেডারিক আদ্য শব্দ দুটি ব্যবহার করেননি। যে দুটো খ্রিস্টধর্মাবলম্বীর পরিচয় বহন করে। প্যারিসে হিজরতের পর চিঠিপত্রসহ সর্বত্র কেবল ‘স্যামুয়েল হ্যানিমান’ লিখতেন। স্যামুয়েল ইসরাইল বংশীয় একজন নবীর নাম হিসেবেও গ্রহণযোগ্য। এ কথা তার খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগের আর একটি শক্তিশালী প্রমাণ।


ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ম্যাগাজিনের ২৪৫ পৃষ্ঠায় স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। মাদাম ম্যালনি তার স্বামী হ্যানিমানের মৃত্যুপূর্ব ওসিয়তের কারণে কোনো অমুসলিমকে তার দাফনে অংশগ্রহণ করতে দেননি। তিনি দাফনের দিনক্ষণ সবই গুপ্ত রেখে মুসলমানের সাক্ষাৎ পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করে ছিলেন। হ্যানিমানের মৃত্যু ২ জুলাই ১৮৪৩ তারিখে। কোনো মুসলমানের সাক্ষাৎ না পেয়ে ম্যালনি নিজে তার সমবিশ্বাসী (নবদীক্ষিত মুসলিম) দৃঢ়প্রত্যয়ী দুই ব্যক্তির সহযোগিতায় চিকিৎসাবিজ্ঞানী হ্যানিমানকে মৃত্যুর ৯ দিন পর ১১ জুলাই কবরস্থ করেন। হ্যানিমানেরই ইচ্ছা অনুযায়ী প্যারিসের অখ্যাত মাউন্ট মারাট্টির গোরস্তানে তাকে দাফন করা হয়।


নিরাপত্তা ও শান্তির সন্ধানে তিনি ১৮৩৫ সালের জুন মাসে ৮০ বছর বয়সে তার পৈতৃক দেশ জার্মানি ত্যাগ করেন। আর কখনো তিনি বা তার স্ত্রী ফ্রান্স থেকে জার্মানিতে ফিরে যাননি। এতে প্রমাণিত হয় ইসলাম গ্রহণের ফলে বিজ্ঞানী হ্যানিমান ও মাদাম ম্যালনির জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তা জার্মানিতে কতটুকু বিপন্ন ছিল।
হ্যানিমানের কিছু প্রবাদতুল্য উক্তি রোগীকে চিকিৎসা কর, রোগকে নয়। অথচ কিছু কিছু হোমিও চিকিৎসক বের হয়েছে, এরা রোগীর লক্ষণ নির্বাচন না করে রোগের নামে চিকিৎসা দিয়ে থাকে, তাই আজকের এই দিনে হ্যানিমানের কথা স্মরণ করে, হ্যানিমানের অতীতের গুণগুলো মাথায় রাখতে পারলে সেই হলো প্রকৃত হোমিওপ্যাথ।


লেখক:  জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা