logo
আপডেট : ১০ এপ্রিল, ২০২২ ১১:৫২
অধ্যাপক তাহের হত্যাকাণ্ড, বিচার এবং প্রাসঙ্গিক পরিস্থিতি
নিজস্ব প্রতিবেদক

অধ্যাপক তাহের হত্যাকাণ্ড, বিচার এবং প্রাসঙ্গিক পরিস্থিতি

উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত অধ্যাপক তাহেরের কন্যা পিতা হত্যার প্রতিশোধের তীব্র বাসনা থেকে নিজেকে আইনজীবী হিসেবে গড়ে তোলেন

একটা সময় ছিল যখন প্রতিক্রিয়াশীলদের আঘাতে প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দের নিহত হওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। এখনো তা নানাভাবে চলমান রয়েছে। এরূপ হত্যাকাণ্ডের সূচনা ঘটে ২০০৪ সালে প্রথাবিরোধী লেখক, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হত্যাচেষ্টার মধ্য দিয়ে (২৭ ফেব্রুয়ারি)। একুশের বইমেলা থেকে ফেরার পথে তাকে আঘাতের পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন ওই বছরের আগস্ট মাসে। একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর ভোরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস-সংলগ্ন এলাকায় প্রাতর্ভ্রমণের সময় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অর্থনীতি বিভাগের প্রগতিশীল অধ্যাপক ইউনুসকে। তারপর অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যাকা- ঘটে ২০০৬ সালে। প্রথম দুটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীলরা সরাসরি জড়িত; বিচার প্রক্রিয়া চলমান- রায় আসন্ন; রায় হয়েছে শাস্তি হয়নি; কিংবা শাস্তি লঘু করা হয়েছে। অধ্যাপকদের হত্যার বিচারের গতি অতিশ্লথ। কারণ সমাজে অধ্যাপকদের ক্ষমতা খুবই সীমিত। যা হোক, প্রথম দুটি হত্যাকাণ্ডের তুলনায় অধ্যাপক তাহের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তথাকথিত আদর্শ অপেক্ষা ব্যক্তিস্বার্থ প্রধান। হত্যার প্রধান আসামি তারই ছাত্র এবং একই বিভাগের (ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা) শিক্ষক, মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনও অবশ্য একটি প্রতিক্রিয়াশীল দলের সমর্থক/নেতা। এখানে তার দল অপেক্ষা তার ব্যক্তিস্বার্থ মুখ্য। কারণ, অধ্যাপক তাহেরকে তার অন্যায্য পদোন্নতির পথে বাধা মনে করে হত্যা করা হয়।

উল্লেখ্য যে, অধ্যাপক ইউনুস হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায়ে ২০১০ সালে নিম্ন আদালত মো. শহিদুল্লাহ ওরফে মাহবুব ও মো. শফিউল্লাহ ওরফে তারেক নামের জেএমবির দুই নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। অন্য ছয় আসামিকে খালাস দেন আদালত। এরপর ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল পুনর্বিচারের রায়ে জেএমবির দুই সদস্যের মৃত্যুদণ্ড রহিত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আদেশ দেন। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, লেখক ও ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদ হত্যাচেষ্টা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আগামী ১৩ এপ্রিল। হত্যার প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হোক এবং প্রকৃত আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত হোক- এটাই আমাদের চাওয়া। অধ্যাপকদের আর ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে না; তাদের হত্যার বিচারটা অন্তত হোক।


অধ্যাপক তাহের হত্যার ১৬ বছর পর তা আবারো দেশজুড়ে আলোচিত হবে, আলোড়িত হবে এটি ভাবনার অতীত। অবসর কিংবা মৃত্যুর পর অধ্যাপকদের স্মরণ করা হয় না খুব একটা। খুনের পর তো নয়ই। তবে অধ্যাপক তাহের হত্যার বিচার নিশ্চিত করার পেছনে তার পরিবারের, বিশেষ করে তার স্ত্রী, পুত্র ও নির্দিষ্ট করে তার কন্যা, শেগুফতা তাবাসসুমের অবিরত লেগে থাকা সংগ্রাম ও দৃঢ়তৎপরতা অনস্বীকার্য। প্রায় ভুলে যাওয়া এই হত্যাকা-কে বিচারের মুখোমুখি করে সবার সামনে উপস্থিত করার জন্য অধ্যাপক তাহেরের পরিবারের দীর্ঘদিনের অপেক্ষা দেশের মানুষের আবেগকে নাড়া দিয়েছে। শেগুফতা তাবাসসুমের ভূমিকায় আজ অনেক বাবাই গর্বিত; সবার ঘরে যদি এমন যোগ্য সন্তান থাকত!


অধ্যাপক তাহেরকে হত্যার পর তার পুত্রসন্তান পরিবারের দায়িত্ব নেয় এবং উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত কন্যা পরবর্তীতে পিতা হত্যার প্রতিশোধ তীব্র বাসনা থেকে নিজেকে আইনজীবী হিসেবে গড়ে তোলেন এবং পিতার হত্যার রহস্য উন্মোচন করে প্রকৃত দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করেন। ১৬ বছরের সংগ্রামের ফসল হিসেবে তারা অধ্যাপক তাহেরের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আদালতের রায় আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। রায় শোনার পর তারা ১৬ বছর ধওে, বিশেষ করে ২০০৬ সালে হত্যাকাণ্ডের সময়কালে এবং হত্যাকাণ্ডের রায় প্রদানকালে সাংবাদিক ও প্রগতিশীল মানুষদের ইতিবাচক ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন। অধ্যাপক তাহেরের পরিবারের মতো আমরাও এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের রায় কার্যকর দেখতে চাই। যেদিন এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হবে, সেদিন তাকে হারানোর বেদনা কিছুটা প্রশমিত হবে; যদিও কোনো কিছুর বিনিময়ে তাকে আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। অধ্যাপক তাহেরের মতো অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ও অধ্যাপক ইউনুসের হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত হওয়াও আইনের শাসন ও শোকসন্তপ্ত পরিবার ও স্বজনদের প্রতি সমবেদনার জন্য সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ।


এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক তাহেরের পরিবার এবং বিশেষ করে তার মেয়ে আইনজীবী শেগুফতা তাবাসসুমের সংকল্প এবং প্রচেষ্টার জন্য তাকে সম্মান জানাতে হয়, অভিনন্দন জানাতে হয়। তাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হয় দুটো কারণে : প্রথমত পিতার হত্যার বিচারের প্রশ্নে তার সারাজীবনের সংগ্রাম; সে জন্য তাকে লাল সেলাম এবং সাধুবাদ; অন্যদিকে এশটি ঘৃণ্য অপরাধের বিচার নিশ্চিত করার জন্য তাকে অভিবাদন জানাই। এর মধ্য দিয়ে আমরা উপলব্ধি করতে চাই অন্যায়ের বিচার হবেই হবে। দুষ্কৃতকারীরা কিছু সময়ের জন্য নিজেদের বিচার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও ইতিহাসের কাছে এবং বাস্তবতার কাছে একদিন তাদের বিচার হবেই। তাদের বিচারের জন্য হয়তো সব পরিবারে অধ্যাপক তাহেরের মতন যোগ্য ও সংগ্রামী সন্তান নাও থাকতে পারে, কিন্তু অপরাধের বিচার কোনো না কোনোভাবে হবেই। এই বাস্তবতাকে সমাজ এবং সমাজের যত দ্রুত মানুষ মেনে নিচ্ছে ততই মঙ্গল।


হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক বা না হোক, নিহত ব্যক্তিকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। এই বাস্তবতা থেকে অধ্যাপক তাহের, অধ্যাপক ইউনুস, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এবং তাদের মতো দেশের অপরাপর শিক্ষকদের সম্মানজনক অবস্থান, সামাজিক অবস্থান, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে ভাবনা প্রয়োজন। দেশের শিক্ষকদের বিষয়ে সাধারণ মানুষের যে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্মান ছিল, আজ তা কোন পর্যায়ে পর্যবসিত হয়েছে সেটি ভাববার বিষয়। শিক্ষকরা আজ নানাভাবে অসম্মানিত। শিক্ষকদের যখন অসম্মান করা হয় তখন অনেকের কাছে বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক এবং সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু যে দেশে শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়, যে দেশের শিক্ষকদের আত্মমর্যাদা থাকে না আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে এবং যে দেশের শিক্ষকদের কটাক্ষ করা হয়, সে দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হতে পারে, প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত হবার সম্ভাবনা থাকে না।


অধ্যাপক তাহেরসহ সকল হত্যাকাণ্ডের বিচারের মধ্য দিয়ে এই উপলব্ধি করতে চাই ব্যক্তিস্বার্থ আজ কতটা প্রকট যে, পদোন্নতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে ভেবে তাকে অপর শিক্ষক (যিনি এক সময় তার ছাত্রও ছিলেন) তাকে খুন করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। এই যদি হয় সমাজের অবস্থা, শিক্ষকদের ক্ষমতাবানরা কান ধরে উঠবস করতে পারেন, স্থানীয় কাউন্সিলর কর্তৃক শিক্ষক লাঞ্ছিত হতে পারেন, টেলিফোনে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা গালমন্দ করতে পারেন, সবই সম্ভব। যে দেশে এসব সবই সম্ভব, দেশের প্রকৃত বিকাশ ও মানবিক উন্নয়ন প্রায়ই অসম্ভব। যে দেশে শিক্ষকদের সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মনোভাব, বিকাশ, সামাজিকীকরণ ও সমাজ বাস্তবতা বিরূপ এবং যে রুঢ় সমাজ বাস্তবতায় আমরা দাঁড়িয়ে সে সমাজ বাস্তবতা থেকে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের কল্পনা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়।


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবদ্দশায় শিক্ষকদের যেভাবে সম্মান দেখিয়েছিলেন, শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন, সেটি বর্তমান সমাজে অনেকটা অনুপস্থিত। ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতা, মুনাফা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নই এখন মুখ্য। বিদ্যমান অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া কঠিন হয়ে পড়ছে। যতদিন না সমাজে শিক্ষার গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে এবং শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অনুকূল অনুষঙ্গ তথা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের সুযোগসুবিধা, শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান, নিরাপত্তা এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত হবে ততদিন পর্যন্ত দৃশ্যমান উন্নয়ন কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক হবে না। উন্নয়ন দেখা যাবে, অনুভব করা যাবে না। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ভাবাদর্শে শোষণহীন সোনার বাংলা গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রতি বর্তমান সরকার আরো মনোযোগী হবেন সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।


লেখক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক