দিনভর রিকশা চালিয়ে ঠিক ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে হাজির আবুল মিয়া। ইফতার ভর্তি থালার পাশে বসে পড়লেন। ইফতারে দেওয়া হয়েছে ছোলা, বুট, মুড়িসহ ইফতারির নানা পদ। পাশাপাশি আছে তরমুজ, বাঙ্গি, আনারসসহ বিভিন্ন ফল। আছে খিচুড়ি, বিরিয়ানিসহ ভারী খাবারও। মাগরিবের নামাজের আজান হতেই শুরু করলেন ইফতার করা। তার পাশে বসে একই থালায় ইফতার করছেন মো. আবুল কাশেম, মো. শাহজাহানসহ বেশ কয়েকজন। শুধুই আবুল মিয়া, আবুল কাশেম বা শাহজাহান নন, এরকম একেক থালায় ৫-৬ জন করে ইফতার করছেন। তারা সবাই বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন। কেউ কাউকে চেনেন না। কেউ কারো আত্মীয় নন। তারপরও অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি হলেও নেই কোনো কোলাহল, হুড়াহুড়ি। ঘণ্টাখানেক আগেও তারা কেউ কাউকে চিনতেন না। অথচ একসঙ্গে বসে একই পাত্রে শুরু করলেন ইফতার। হয়তো আর কখনো দেখাও হবে না। তবু পরস্পরের মধ্যে অভূতপূর্ব দরদ লক্ষ করা গেল। এ যেন সংযমের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের এক অপার দৃশ্য। পবিত্র মাহে রমজানে মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের পরম নিদর্শন। এ চিত্র রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র হাইকোর্ট মাজারের।
রাজধানীর হাইকোর্ট এলাকায় সুপ্রিম কোর্ট মাজার ও মসজিদ কমপ্লেক্সে গতকাল সন্ধ্যায় দেখা গেলে সম্প্রীতির এমনই উদাহরণ। সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান, শ্রেণি-পেশার ভেদাভেদ ভুলে এখানে প্রতিদিনই ইফতার করে থাকেন হাজারো মানুষ। সেখানে একইসঙ্গে বসেছেন প্রবীণ সরকারি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কাশেম, হাইকোর্টের স্টাফ মো. শাহজাহান, রিকশাচালক আবুল মিয়া ও গুলিস্তানের হকার সেলিম। তারা সবাই সবার কাজ শেষে এসে বসলেন হাইকোর্টের মসজিদে ইফতারের আয়োজনে। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কাশেম বলেন, এমনিতে হোটেলেই ইফতার করার পরিকল্পনা ছিল। তবে আজ দেরি হওয়াতে ইফতারের সময় হয়ে যাওয়ায় হাইকোর্টের মসজিদে এলাম। এখানের ইফতার আয়োজন দেখে বেশ ভালো লেগেছে। সাধারণত গ্রামে এরকম দেখা যায়। হাইকোর্টের স্টাফ মো. শাহজাহান প্রায়ই ইফতার করে বাসার উদ্দেশে রওনা দেন। তিনি বলেন, এখানে খাবারের কোনো অভাব নেই। প্রায়ই এখানে ইফতার করি সবার সঙ্গে। মন-দিল-আত্মায় শান্তি লাগে। রংপুরের বাসিন্দা আবুল মিয়া ৩ বছর ধরে রিকশা চালান ঢাকাতে, থাকেন রামপুরা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় রিকশার ক্ষ্যাপে এসেছিলেন। গতকাল জেনেছেন, এখানে বিনামূল্যে ইফতার দেওয়া হয়। রোজা রেখেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহর দুনিয়ায় কারো খাবারের অভাব হয় না।
বাড্ডার বাসিন্দা সেলিম। পেশায় এ ব্যক্তি গুলিস্থানে হকারি করেন। গত ২৫ বছর ধরে তিনি এ মাজারে আসেন। সবচেয়ে বেশি যাতায়াত করেন রোজার মাস এলে। হান্নান ভোরের আকাশকে বলেন, বছরজুড়ে নানা অনুষ্ঠান থাকে এখানে। তখনো আসি। আর রোজার প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার আসা হয়। এখানে কে বড়লোক, কার টাকা কম এমন প্রতিযোগিতা নেই। এখানে আমরা সবাই সমান। এখানে বসলে আত্মার তৃপ্তি হয়। যুগের পর যুগ ধরে সম্প্রীতির বন্ধনে বাঁধা এমন ইফতারের আয়োজন প্রসঙ্গে কথা হয় মসজিদের ইমাম আহমেদ রেজা ফারুকীর সঙ্গে। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, মসজিদ শুধু প্রার্থনার জায়গা নয়। মসজিদে ইফতারের এমন উদ্যোগ মূলত ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের সেতু এবং সাম্য বজায় রাখার একটা উদাহরণ। এখান থেকে মানুষ ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের ভিত্তিতে গড়া ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা পায়।
মসজিদ কমিটি খাদেম জানায়, প্রতিদিন ১২০০ থেকে ১৫০০ মানুষের ইফতারের আয়োজন থাকে। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন প্রায় ৪০ জন। তবে শুক্রবার ও বৃহস্পতিবার মানুষের সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এ আয়োজন করতে মসজিদ কমিটির দৈনিক খরচ পড়ে গড়ে ২৫ হাজার টাকা। তবে অনেক ভক্তও এখানে বিভিন্ন ইফতারসামগ্রী দিয়ে থাকেন। হাইকোর্ট মাজারে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের জন্যও ইফতারের বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিন দুই থেকে তিনশত নারী ইফতারে অংশ নেন। মাজার কমিটির সদস্যরা জানান, ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণের পর মুসল্লিদের অংশগ্রহণ অনেক কমে ছিল। তবে এবারের ইফতারের আয়োজন করোনার আগের মতোই।
এদিকে মসজিদের ভেতরের এ আয়োজনের পাশাপাশি মসজিদ সংলগ্ন দক্ষিণ পাশের কড়ই গাছতলায় চলে আরেক দলের ইফতারি বিতরণ। খাজা কাশেম আলী শাহ চিশতি (রহ.) স্মরনে ৫৭ বছর যাবত এখানের ইফতার করানো হয়। মূলত মাজারের ভক্তদের দান ও স্বেচ্ছা উদ্যোগে হয় এ আয়োজন। হাইকোর্টের এ অংশে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন ১৫ জন। এ স্থানের প্রধান খাদেম মো. যোবায়ের হোসাইন জিহাদ বলেন, প্রতিদিন এখানে ৫০০ থেকে ৭০০ মানুষের ইফতারের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে সাড়ে তিনশ জন অসহায়, প্রতিবন্ধীর জন্য আয়োজন করা হয়। প্রতিটি প্লেটে একেক করে শসা, বাঙ্গি, পেয়ারা, আনারস, পেঁপেসহ নানা পদের ফল কেটে দেওয়া হয়। প্রতিদিন ৩৪ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে ১৭ হাজার টাকার শুধু ফল কেনা হয় বলে জানান এ খাদেম।