logo
আপডেট : ১১ এপ্রিল, ২০২২ ১৪:১৪
আনন্দ-বেদনার কবুতরহাট
শিপংকর শীল

আনন্দ-বেদনার কবুতরহাট

গুলিস্তানের কাপ্তান বাজারের এই কবুতরের হাটে সবচেয়ে দামি ‘হোমার’ জাতের কবুতর। এক জোড়া কবুতরের দাম লাখ টাকারও বেশি। ছবি- ভোরের আকাশ

কবুতর গৃহপালিত পাখি নামে পরিচিত। প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন ও নিরীহ। দেখতে বেশ চমৎকার। বিভিন্ন রঙের ও ঢঙের। সাদা, কালো, সিলভার, হলুদ, খয়েরি ও নীল বর্ণের। কবুতর মানুষের রাগ-অনুরাগ বোঝে। শত্রু-মিত্র চেনে। একবার যাকে দেখে তাকে আর ভুলে না। কবুতরের ডিগবাজি, ভেল্কিবাজি ও উড়োউড়ি মানুষকে বিমোহিত করে।

কবুতর শান্তির প্রতীক। এজন্য যে কোনো শুভ অনুষ্ঠানে শান্তির শ্বেতকপোত উড়ানো হয়। কবুতর উড়ানোর প্রথা সেকাল থেকে অদ্যাবধি প্রচলিত আছে। আগেকার দিনের শাসক ও অভিজাত শ্রেণি পায়রার মাধ্যমে সংবাদপত্র আদান-প্রদান করত। মুঘল আমলে লক্ষ্মৌর নবাবরা পায়রা নিয়ে দিনমান কাটিয়ে দিতেন। অনেক নবাব-রাজা-বাদশার এ ধরনের শখ ছিল। উনিশ শতকে কলকাতার বাবুরা ডুবে গিয়েছিল বিলাসবসনে। তারা কবুতরের বিয়েতে লাখ লাখ টাকা খরচ করত। কবুতর নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক গান, গল্প, কবিতা। আমাদের দেশেই নয় কবুতর নিয়ে অন্যান্য ভাষা, সাহিত্যেও সৃষ্টি হয়েছে অনেক সাহিত্যকর্ম। শুধু শিল্প-সাহিত্যে নয়, প্রাচীনকালে পত্র যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল কবুতর। আদিম যুগে কবুতরের মাধ্যমেই দূর দূরান্তে চিঠি আদান-প্রদান করা হতো।

যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হলেও বাঙালির জীবনের সঙ্গে কবুতরের সম্পর্ক আজও গভীর। অনেকেই শখের বশে কবুতর পোষেণ। কিশোর থেকে বৃদ্ধ প্রায় সব বয়সের শৌখিন কবুতর প্রেমীরা কবুতর পালন করেন গভীর মমতা ও উচ্ছ্বাস নিয়ে। নিজেদের আনন্দ, উচ্ছ্বাস এবং ভালোবাসা একে অপরের মাঝে ছড়িয়ে দিতে প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার কবুতরপ্রেমীরা একত্রিত হন গুলিস্তানের কাপ্তান বাজারের কবুতরের হাটে। সকাল ৭টা থেকে এই বাজার জমতে শুরু করে। রাজধানী ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন কবুতর নিয়ে এই হাটে আসেন। আর এই কেনাবেচা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত।

২০০ জাতের কবুতরের মধ্যে বাংলাদেশে আছে প্রায় ৩০ জাতের কবুতর। বিভিন্ন রং, বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ, চোখের রং ও আকৃতির ওপর ভিত্তি করে কবুতরের নামকরণ বা জাত ঠিক করা হয়। কোনো কবুতর বড়, কোনোটা ছোট। কোনো কবুতর দেখতে সুন্দর আবার কোনোটা আকাশে চমৎকার খেলা দেখায়। এক এক জাতের কবুতরের এক এক গুণ। বাংলাদেশে পাওয়া যায় এমন জাতগুলো হলো দেশি কবুতর গোলা, হোমার বা হোমিং পিজিয়ন, গিরিবাজ, ভারতীয় জাতের লাক্ষা, শৌখিন সিরাজী, কাগজি, চিলা, গোররা, চুইনা, রান্ট, প্রিন্স, জ্যাকোবিন, পটার, ফ্রিল ব্যাক, স্ট্রেসার, মডেনা, মুসল দম, নোটন ও কিং। বাংলাদেশে কবুতরের জাতের মধ্যে গিরিবাজ সবচেয়ে জনপ্রিয়।

গুলিস্তানের কাপ্তান বাজারের এই কবুতরের হাটে সবচেয়ে দামি ‘হোমার’ জাতের কবুতর। এক জোড়া কবুতরের দাম লাখ টাকারও বেশি। এই কবুতরের বিশেষত্ব হল, এরা অনেক সময় ধরে উড়তে পারে। প্রাচীনকালে এই কবুতর উড়াল প্রতিযোগিতায় ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া যত দূর থেকেই এই কবুতরকে ছেড়ে দেওয়া হোক না কেন, নির্দিষ্ট জায়গায় ফিরে আসবে। তবে এখন এত দামের কবুতর হাটে আসে না বলে জানান কবুতরের পাইকার ব্যবসায়ী করিম।

কাপ্তান বাজারের কবুতরের এই হাট ঘুরে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় গিরিবাজ কবুতর। এই জাতের মধ্যেও বিভিন্ন প্রকারের কবুতর রয়েছে। এই জাতের কবুতর আকাশে ডিগবাজি খায় বলে এদের টাম্বলার বলে। এরা আকাশে অনেক ধরনের খেলা দেখাতে পারে। কবুতরপ্রেমী থেকে শুরু করে সবাই এই কবুতর পছন্দ করে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সবুজ গলা ও লাল গলা গিরিবাজ। এদের জোড়ার দাম ৩০০ থেকে শুরু করে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত হয়। এ ছাড়া বড় আকারের কবুতর কিং জাত বিক্রি হয় ১০ থেকে ২০ হাজার টাকায়, তীব্র ও জোরালো ডাকের র‌্যাগস জাত বিক্রি হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায়, ময়ূরি জাত ২ থেকে ৩ হাজার টাকায়, সিরাজি জাত ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায়, শাটিং জাত ২ হাজার টাকা জোড়ায় বিক্রি হচ্ছে।

একদিকে রমজান অন্যদিকে ঠিক দাম না পাওয়ায় বিক্রি হয়নি কবুতর, অন্যদিকে ইজারাদারকে দিতে হচ্ছে খাঁচা প্রতি ১০০ টাকা করে। তাই ক্ষোভ নিয়েই হাট ত্যাগ করছেন অনেকে। বিশেষ করে হাটের নতুন বিক্রেতারা পড়েছেন আরো বিপাকে।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় শরীয়তপুর থেকে কবুতর বিক্রি করতে আসা ফরিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, রমজানের আগে ১০-১২ জোড়া কবুতর বিক্রি হতো। এখন সারাদিনে ৩-৪ জোড়া হয় না। তাই মনটা ভালো নয়। তিনি আরো বলেন, বিক্রি হোক আর না হোক খাঁচা প্রতি ১০০ টাকা করে দিতে হবেই। সেজন্য চিন্তায় আছি। আশাকরি বিকেলে বিক্রিটা বাড়তে পারে।

একদিকে হাটে যেমন বিভিন্ন ব্যক্তি আসেন তাদের পোষা কবুতর বিক্রি করতে, একইভাবে পাইকার বিক্রেতারাও কবুতর বিক্রি করে থাকেন এই হাটে। ক্রেতা কিংবা বিক্রেতা যেই হোক, কবুতরের এই হাট থেকে খাঁচা নিয়ে বের হলেই দিতে হবে ১০০ টাকা। এ ছাড়াও কেউ কবুতর বিক্রি করলে তাদের কাছে থেকে বিক্রির অর্থের ১০ শতাংশ হাটের ইজারাদারকে দিতে হয়। বিক্রি করতে আসা কবুতর বিক্রি না হলেও গুনতে হবে ১০০ টাকা। এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা যায় ক্রেতা বিক্রেতাদের মধ্যে। এই হাট ছাড়া অন্য হাটে এত টাকা ইজারা দিতে হয় না।

তবু কেন এখানেই আসেন, এমন প্রশ্নের জবাবে পুরান ঢাকা থেকে আসা কবুতরপ্রেমী নয়ন বিশ্বাস জানান, পুরান ঢাকা থেকে এই হাট খুবই কাছে। তাই সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এই হাটে এসে শখের কবুতর দেখি এবং পছন্দ মতো কিনি। তা ছাড়া এই হাটে নানান জাতের দেশি বিদেশি কবুতর ওঠে, যেগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। তাই সপ্তাহে একদিন এই হাটে আসি।

এ নিয়ে কথা হয় কবুতর বিক্রেতা মাসুমের সঙ্গে, তিনি বলেন, সব ধরনের কবুতর বিক্রি হয়। রমজানের আগে ১৪-১৫ জোড়া কবুতর বিক্রি হতো। এখন সে রকম বিক্রি হয় না। আশাকরি রোজার পর আবার আগের মতো বিক্রি হবে। তিনি বলেন, ঢাকায় অনেক জায়গায় কবুতর বিক্রি করা হয় কিন্তু এখানে বসানোর কারণ হল বেচাকেনা ভালো হয় এবং ভালো দাম পাওয়া যায়। এ ছাড়া এখানে পোষার জন্য কবুতর বিক্রি করা হয় ।

কবুতরের এই হাটে সকলেই ক্রেতা, আবার সকলেই বিক্রেতা। এদের কেউ কেউ আসেন ভিন্ন জাতের কিছু কবুতর কিনে নিজের সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ করতে, আবার কেউ আসেন বাড়তি কিছু অর্থ উপার্জন করতে। কবুতরের পাশাপাশি ভিন্ন কিছু পাখির দেখাও মিলে এই হাটে। ভোরের আলো ফোটার পর থেকে সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জমে ওঠে কাপ্তানবাজার কবুতরের হাট। কবুতরপ্রেমীদের অনেক আনন্দ-বেদনা আর বিরহ-মিলনের সাক্ষী এই কবুতর হাট।