logo
আপডেট : ১২ এপ্রিল, ২০২২ ০৮:৫৭
দক্ষ শ্রমিক পাওয়ার প্রক্রিয়া হ্রাস পাচ্ছে
জাফর আহমদ

দক্ষ শ্রমিক পাওয়ার প্রক্রিয়া হ্রাস পাচ্ছে

করোনায় অনেক শ্রমিক চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। ফাইল ছবি

আসাদুল ইসলাম মিরপুরের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় প্যান্টের বেল্ট জয়েন্ট মেশিনের অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। তার সঙ্গে কোনো সহকারী নেই। নিজেই বেল জয়েন্ট করেন। বেল্ট জয়েন্ট করার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে সুতা কেটে দেন। কোনো হেলপারের প্রয়োজন হয় না। পাঁচ বছর আগে যখন আসাদুল কারখানায় হেলপার হিসাবে যোগদান করেন তখন তিনি একই ধরনের মেশিনের হেলপার হিসেবে চাকরি শুরু করেন। তার সঙ্গে আরো একজন হেলপার ছিল। পাঁচ বছর আগের তুলনামূলক কম উন্নত মেশিনে দুজন হেলপারসহ যে কাজ করতেন, এখন উন্নত মেশিনে কোনো হেলপার ছাড়াই তার চেয়ে বেশি কাজ করছেন। গাজীপুরের ইস্টওয়েস্ট কারখানাতেও একই তথ্য মিলেছে।

তৈরি পোশাকশিল্পের মেশিনের উন্নতি ও শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির কারণে শ্রমিক তৈরি হওয়ার হেলপার হিসেবে কারখানায় প্রবেশের সুযোগ কমে যাচ্ছে। এর ফলে তৈরি পোশাকশিল্পে প্রয়োজন অনুযায়ী শ্রমিক মিলছে না। তৈরি পোশাকশিল্পের মূল জায়গা হলো সেলাই শাখা। যেখানে দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এন্ট্রি লেভেলে হেলপার নিয়োগ কমে যাওয়ার কারণে দক্ষ অপারেটরের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। শ্রমিক স্বল্পতা নিয়েই চলছে তৈরি পোশাকশিল্প।

করোনা মহামারির পর থেকে তৈরি পোশাকশিল্পে প্রয়োজন অনুযায়ী শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রমিক না থাকার কারণে অনেক কারখানায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। কারখানার সম্প্রসারণ করতে অন্যান্য উদ্যোগ সম্পন্ন হলেও শ্রমিকের অভাবে চালু করতে পারছে না। ক্রেতাদের কাছে থেকে কার্যাদেশ পাওয়ার পরও সাব-কন্ট্রাক্টে অন্য কারখানায় কাজ করিয়ে সরবরাহ করতে হচ্ছে। অনেক কারখানা কার্যাদেশ দেওয়ার সময় কম লিটটাইম হওয়ার কারণে কার্যাদেশ নিচ্ছে না। এসব কাজ পরে হাত ছাড়া হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে।

তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সিনিয়র সভাপতি শহিদুল্লাহ আযিম ভোরের আকাশকে বলেন, করোনার আগে থেকে আমরা তৈরি পোশাকশিল্পে দক্ষ শ্রমিক স্বল্পতায় ভুগছি। করোনার সময় শ্রমিকরা চাকরি ছেড়ে চলে গেছে, ফেরত আসেনি। সেই সঙ্গে কার্যাদেশ বেড়ে গেছে। এসব কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শুধু দক্ষ শ্রমিকেরই অভাব প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ।

তৈরি পোশাক কারখানায় মেশিন আধুনিক হওয়ার কারণে মেশিনপ্রতি শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তার অনুপাত কমে এসেছে। তবে তা নির্ভর করছে উদ্যোক্তার সক্ষমতার ওপর। যেসব কারখানা বড় এবং আধুনিক মানে উন্নিত করা সম্ভব হয়েছে সেসব কারখানার মেশিন অতি আধুনিকায়ন করেছে, শ্রমিকের দক্ষতা বেড়েছে বা দক্ষ শ্রমিকের সমাবেশ ঘটানো সম্ভব হয়েছে, সেসব কারখানায় অপারেটররা একাই একটি প্রসেসের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে। এর ফলে হেলপারের প্রয়োজন কম হয়, মেশিনপ্রতি শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে তুলনামূলক দুর্বল কারখানা বা ছোট্ট কারখানা অতি আধুনিক মেশিন সংগ্রহ করতে পারেনি, বেশি বেতন দিয়ে ভালো শ্রমিকও নিতে পারেনি। ফলে কম দক্ষতার শ্রমিক দিয়েই কাজ করছে। এবং মেশিন প্রতি বেশি শ্রমিক দিয়ে কাজ করছে।

প্রাথমিক পর্যায়ের হেলপারের প্রয়োজনীয়তা কমে আসার বিষয়টি স্বীকার করেন তৈরি পোশাকশিল্প খাতের আধুনিক উদ্যোক্তা ও বিজিএমইএ-এর নেতা শোভন ইসলাম। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, এন্ট্রি লেবেলের হেলপার বা অদক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে এটা ঠিক। বর্তমানে তৈরি পোশাক কারখানাতে মেশিন-শ্রমিক অনুপাত ২.৩ বা এর চেয়ে কিছুটা বেশি। অর্থাৎ কারখানায় প্রতিটি মেশিনের বিপরীতে ২.৩ জন শ্রমিক রয়েছে। কয়েক বছর আগে মেশিন প্রতি শ্রমিকের সংখ্যা ৩ এর উপরে। মূলত মেশিনের আধুনিকায়ন, দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ ও শ্রমিকের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি শ্রমিককে ধরে রাখার কারণে এ অগ্রগতি হয়েছে। এখন অপারেটরই প্রসেসটি সেলাই করার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেশিন দিয়ে সুতা কেটে দিচ্ছে। এ কারণে এন্ট্রি লেভেলে হেলপারের প্রয়োজনীয়তা কিছুটা কমেছে। তবে যে হেলপারই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তাদের দ্রুত কাজ শিখিয়ে অপারেটর হিসাবে মেশিনে বসানো হচ্ছে; জুনিয়র অপারেটর হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, বেতন বাড়ানো হচ্ছে। মূলত দক্ষ শ্রমিকের অভাবে এটা করছে।

তৈরি পোশাকশিল্পের হেলপার নিয়োগ কমে আসার কারণে শ্রমিক হওয়ার প্রক্রিয়া সংকুচিত হয়েছে। এর পেছনে প্রযুক্তিও কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। প্রতি সেকেন্ড ও মিনিটে প্রতিটি মেশিন কী পরিমাণ সেলাই করা যায়, তারও হিসাব করা হচ্ছে। তৈরি পোশাকশিল্পে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়াররা এসব হিসাবে করছে। এর ফলে একজন অপারেটরকে সক্ষমতার সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে, কর্মী হিসাবে তার দক্ষতা বাড়ছে। এ বিষয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ার ও বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের সিনিয়র ম্যানেজার আব্দুল মালেক বলেন, সেলাই বিভাগে আগের তুলনায় ১২ থেকে ১৫ ভাগ হেলপার নিয়োগ কমানো হয়েছে। এসব হেলপারকে আগে অপ্রয়োজনীয় ও আননেশেসারি নিয়োগ দেওয়া হতো। আমরা প্রতি সেকেন্ড ও মিনিটে সেলাইয়ের ক্ষমতা বের করে হেলপারের প্রয়োজন নিরূপণ করেছি; প্রয়োজনমতো হেলপার নিয়োগের সুপারিশ করি। এ হিসাবে আমরা দেখেছি, আগে যেখানে ৫০ মেশিনের একটি লাইনে যেখানে ৫০ অপারেটরের পাশাপাশি ১৫ থেকে ১৬ জন হেলপার কাজ করত।

পুরোনো পদ্ধতিতে নিয়োগ পাওয়া শ্রমিক দিয়ে কারখানার শ্রমিকের চাহিদা মিটছে না। কোনো প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া আধাদক্ষ শ্রমিক নিয়োগ দিতে হচ্ছে। কিছু কিছু কারখানা প্রশিক্ষণ দিয়েও জুনিয়র অপারেটর নিয়োগ দিচ্ছে। তারপর দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়ে গেছে। এ বিষয়ে শোভন ইসলাম বলেন, তৈরি পোশাকশিল্প এখনো প্রধান রপ্তানি পণ্য। এ খাতে দক্ষ শ্রমিকের স্বল্পতা দূর করতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে জেলাপর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।