logo
আপডেট : ১২ এপ্রিল, ২০২২ ১২:১৫
তামাকের বর্ধিত কর দিয়েই হৃদরোগের ফ্রি চিকিৎসা!
তামাকজাত দ্রব্যের ওপর করারোপের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাতে গত বছরের চেয়ে ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় সম্ভব
প্রণব কর্মকার

তামাকের বর্ধিত কর দিয়েই হৃদরোগের ফ্রি চিকিৎসা!

প্রতীকী ছবি

তামাকজাত দ্রব্যের ওপর আরো অতিরিক্ত করারোপ করতে হবে। আর অতিরিক্ত রাজস্ব আয় থেকে ৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলেই দেশের দরিদ্র মানুষের হৃদরোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব। প্রতি বছর দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে এমন সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য ও করারোপের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ বছর যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এর বাস্তবায়ন হলে গত বছরের চেয়ে ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় সম্ভব হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এ অতিরিক্ত রাজস্ব আয় থেকে মাত্র ৩.১২ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ দিলেই তিনটি হাসপাতালে এনজিওগ্রাম করা, রিং পরানো রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা সম্ভব।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ মারা যায় হৃদরোগ ও স্ট্রোকে। সাধারণত শহুরে জীবনে যথেষ্ট পরিমাণ শারীরিক পরিশ্রম না করায় ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, প্যারালাইসিসের ঝুঁকি বাড়ছে। পাশাপাশি শরীরে কোলস্টোরেলের মাত্রাও বাড়ছে। এর প্রধান কারণ হলো তামাক বা সিগারেটের ব্যবহার। ধূমপানের কারণে খাদ্যনালি, জিহ্বা, ফুসফুস, বৃহদান্ত্রে ক্যানসারের ঝুঁকিসহ মস্তিষ্কের রক্তনালি ব্লক হয়ে স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে গেছে। হাত বা পায়ের রক্তনালি ব্লক হয়ে ওই অঙ্গ অকেজো হওয়া থেকে শুরু করে অঙ্গহানির ঘটনাও ঘটছে। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে কল্যাণকর রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হলেও তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতি বছর মারা যায় ১ লাখ ৬২ হাজার মানুষ। আর তামাক ব্যবহারজনিত রোগে মৃত্যু ও কর্মক্ষমতা হ্রাসের কারণে বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতি ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, প্রতি বছর বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ ভাগই হচ্ছে অসংক্রামক রোগে। এর মধ্যে ৩৬.১ শতাংশই হৃদরোগী। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, প্রিম্যাচিউরড হার্ট ডিজিজ বা ৫০ বছরের পরপরই অকাল মৃত্যু বেশি হচ্ছে। এমনকি ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সিরাও হৃদরোগে মারা যাচ্ছেন। এর কারণ দেশের বেশির মানুষের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। একইসঙ্গে তাদের একটি বড় অংশ তামাক ব্যবহার করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে মোট ৮ লাখ ৫৪ হাজার ২৫৩ জন মানুষ নানা কারণে মারা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ লাখ ৮০ হাজার ৪০৮ জন মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মানুষের মৃত্যু হয়েছে মস্তিষ্ক রক্তক্ষরণে। এতে মারা গেছেন ৮৫ হাজার ৩৬০ জন।

তামাকজাত দ্রব্য বিশেষত ধূমপান হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম বড়ো কারণ। ফলে রোগী বাড়ার পাশাপাশি এ খাতে চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর (বিইআর) তামাক কর প্রকল্পের অধীন বাংলাদেশ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে এক গবেষণা পরিচালনা করে।

তিন হাসপাতালের তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা গেছে, ২০২১ সালে মোট হাসপাতাল তিনটিতে মোট হৃদরোগের চিকিৎসা নিয়েছে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৫৩৮ জন। এর মধ্যে ভর্তি হয়ে (ইনডোরে) চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখ ৮০৫ জন এবং আউডডোরে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৩ জন। তিন হাসপাতালে ইনডোরে চিকিৎসা নেওয়া ১ লাখ ৮০৫ জন রোগীর মধ্যে এনজিওগ্রাম করেছেন মোট ১৯ হাজার ২৭০ জন। এর মধ্যে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে (এনআইসিডিডি) ৬ হাজার ১৪২ জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ১ হাজার ৫৩৭ ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে (এনএইচএফ) ১১ হাজার ৫৯১ রোগী। অন্যদিকে মোট রিং লাগিয়েছেন ৯ হাজার ২৮২ জন। এর মধ্যে এনআইসিভিডিতে ২ হাজার ৫২৫, বিএসএমএমইউতে ৮৩৪ ও এনএইচএফে ৫৯২৩ জন।

অন্যদিকে ওই বছরে হৃদযন্ত্রের বাইপাস সার্জারি হয় মোট ২ হাজার ১৫১ জনের যাদের ৫৬৯ জন এনআইসিভিডি, ২৩৮ জন বিএসএমএমইউ এবং ১ হাজার ৩৪৪ জন এনএইচএফে সার্জারি করিয়েছেন। এ তিনটি হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা এবং খরচের হিসাব করে দেখা যায়, তিনটি হাসপাতালে ওই তিনটি সেবা নিতে মোট ব্যয় হয় ২৮৬.৬১ কোটি টাকা।

বিভিন্ন সংগঠন আসন্ন অর্থবছরের তামাক কর প্রস্তাবে নিম্ন্ন স্তরের সিগারেটের প্রতি ১০ শলাকার খুচরা মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৩২.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ; মধ্যম স্তরের সিগারেটের প্রতি ১০ শলাকার খুচরা মূল্য ৭৫ টাকা নির্ধারণ করে ৪৮.৭৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ; উচ্চস্তরের সিগারেটের প্রতি ১০ শলাকার খুচরা মূল্য ১২০ টাকা নির্ধারণ করে ৭৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ এবং প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের প্রতি ১০ শলাকার খুচরা মূল্য ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৯৭.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপের প্রস্তাব দেন।

এছাড়া ফিল্টারবিহীন বিড়ির ক্ষেত্রে বাজারে শুধু ২৫ শলাকার বিড়ি রেখে ৮ ও ১২ শলাকার বিড়ি না রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে ২৫ শলাকার খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১১.২৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করার প্রস্তাব দেন। বিপরীতে ফিল্টারযুক্ত বিড়ির ক্ষেত্রে বাজারে ১০ শলাকার বিড়ি না রাখার দাবি জানিয়ে ২০ শলাকার খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৯ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বাজেট প্রস্তাবে জর্দার ক্ষেত্রে প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে ২৭ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করা এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করার প্রস্তাব জানানো হয়েছে।

এছাড়া সব তামাকজাত দ্রব্যের খুচরা মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আগের মতো বহাল রাখারও প্রস্তাব জানান তারা। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রস্তাবিত তামাক করারোপ হলে সরকারের প্রায় ৩৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা বেশি। আর এ রাজস্ব আয়ের মাত্র ৪.৪৫ শতাংশ ব্যয় করলে দেশের সব রোগীর হৃদরোগ চিকিৎসা বিনামূল্যে সম্ভব বলে জানিয়েছেন দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। যেহেতু এই তিন হাসপালে অধিকাংশ হৃদরোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। তাই অনুমান করা যায় অতিরিক্ত রাজস্ব আয় থেকে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের মতো টাকা বরাদ্দ করলেই সারা দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য অনুরূপ হৃদরোগের চিকিৎসা ফ্রি করে দেওয়া সম্ভব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস এম আবদুল্লাহ বলেন, প্রতি বছর বাংলাদেশে কাজ করা তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর করারোপের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করা হয়। এ বছরও ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ ও তামাক কর বিশেষজ্ঞরা তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য ও কর আরোপের একটি প্রস্তাব প্রস্তুত করেছেন এবং তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সেটি সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে। তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে পেশ করা প্রস্তাবে প্রচলিত অ্যাডভেলোরেম কর আরোপ পদ্ধতির পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট কর আরোপ পদ্ধতির প্রবর্তনসহ সব তামাকজাত দ্রব্যের ওপর মূল্য ও করের পরিমাণ প্রস্তাব করা হয়েছে।

তিনি বলেন, হৃদরোগের চিকিৎসার ব্যয়বহুল তিনটি সেবা হলো- এনজিওগ্রাম, স্টেন্টিং (রিং পরানো) এবং বাইপাস সার্জারি। সরকার চাইলেই দেশের সব জনগণের হৃদরোগের চিকিৎসা ব্যয় তামাক খাত থেকে কাক্সিক্ষত অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের খুব সামান্য অংশ দিয়েই মেটাতে পারে। এভাবে ক্যানসার, হাইপার টেনশন, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগের চিকিৎসা ব্যয় সরকার এই অতিরিক্ত রাজস্ব আয় দিয়েই মেটাতে পারে। তবে এজন্য সরকারকে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর প্রস্তাব অনুসারে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর কর আরোপ করতে হবে এবং ত্রুটিপূর্ণ আ্যডভেলোরেম কর আরোপ পদ্ধতির পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট কর আরোপ পদ্ধতির প্রবর্তন করতে হবে।