বহুমাত্রিক লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার রায়ে ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছেন আদালত। বুধবার (১৩ এপ্রিল) ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আল-মামুন এ রায় ঘোষণা করেন।
ড. হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, জার্মানি থেকে পাঠানো মৃত্যু সনদ ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, অ্যানাটমিক্যালি মৃত্যুর যথেষ্ট কারণ পাওয়া না গেলেও টর্চারের (নির্যাতনের ফলে ) ফলে তার মৃত্যু ঘটেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মারাত্মক জখমপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে ও হাইপার টেনশনে তিনি মারা যান।
জার্মানির মিউনিখের হাসপাতাল থেকে পাঠানো ময়না তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারির ঐ তারিখে ঘটনার দিন আসামিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক জখম হন তিনি। এতে তিনি অসুস্থ ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। চিকিৎসার পরও সুস্থ না হয়ে বরং আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট জার্মানির মিউনিখের নেওয়া হয় তাকে। মিউনিখের বাসস্থানে যাওয়ার চার দিন পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ড. হুমায়ুন আজাদ।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন জেএমবির শুরা সদস্য মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ওরফে শফিক, আনোয়ার আলম ওরফে ভাগ্নে শহিদ, সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিন ও নূর মোহাম্মদ ওরফে সাবু।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মহানগর প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় যে চারজন আসামি ছিল তাদের সবাইকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। এ রায়ে আমরা খুশি। রায় দ্রুত কার্যকর হোক সেটা আমরা চাই।
অন্যদিকে, মামলার রায় মেনে নিতে পারেননি আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ। তার ভাষ্য, হুমায়ুন আজাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এবং তিনি হাইপার টেনশনে মারা যান।
১৮ বছর আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির রাতে বাংলা একাডেমির উল্টো পাশের ফুটপাতে আক্রান্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ। যিনি তার লেখার জন্য সাম্প্রদায়িক শক্তির হুমকি পেয়ে আসছিলেন।
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাকে জখম করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ওই হামলার ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। ইসলামি জঙ্গিরা হুমায়ুন আজাদের ওপর ওই হামলা চালিয়েছিল বলে পরে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে। এদিকে কয়েক মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর ২০০৪ সালের আগস্ট গবেষণার জন্য জার্মানিতে যান এই লেখক। ওই বছর ১২ আগস্ট মিউনিখে নিজের ফ্ল্যাট থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার পরদিন তার ছোট ভাই মঞ্জুর কবির রমনা থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। মৃত্যুর পর আদালতের আদেশে অধিকতর তদন্তের পর সেই মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। সিআইডির পরিদর্শক লুৎফর রহমান মামলাটি তদন্তের পর ২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
মো. মিজানুর রহমান মিনহাজ ওরফে শফিক ওরফে শাওন ওরফে হামিম ওরফে হাসিম, আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগ্নে শহীদ, নূর মোহাম্মদ শামীম ওরফে জে এম মবিন ওরফে সাবু, সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তাওহিদ এবং হাফিজ মাহমুদ ওরফে রাকিব ওরফে রাসেলকে সেখানে আসামি করা হয়।
২০১২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় আদালত।
এ মামলার আসামিরা নিষিদ্ধ সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। তাদের মধ্যে মিনহাজ ও আনোয়ার কারাগারে আটক রয়েছেন। নূর মোহাম্মদ শুরু থেকেই পলাতক।
সালাহউদ্দিন সালেহীন ও হাফিজ মাহমুদ গ্রেপ্তার হলেও ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নিয়েছিল জঙ্গিরা। সালেহীন পালিয়ে যেতে পারলেও হাফিজ মাহমুদ পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
আরো পড়ুন:
ঘাতকের আঘাতেই ড. হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু: রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী
ড. আজাদ ঠাণ্ডার কারণে ভদকা খান, মারা যান হাইপার টেনশনে: আসামিপক্ষের আইনজীবী
হুমায়ুন আজাদ হত্যা: ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড