logo
আপডেট : ১৪ এপ্রিল, ২০২২ ১২:৫০
পুরান ঢাকার হালখাতা
হালখাতার উৎসবে রমজানের প্রভাব
শিপংকর শীল

হালখাতার উৎসবে রমজানের প্রভাব

হালখাতা আবহমান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি। পুরোনো হিসাবের খাতা বন্ধ ও নতুন হিসাবের খাতা খোলার আনন্দ-আয়োজন, সঙ্গে আপ্যায়ন ও আনুষ্ঠানিকতার নামই হালখাতা। অর্থাৎ সব হিসাব হালনাগাদ করে নতুন খাতায় তা তুলে ফেলা।

ইতিহাস বলে, বাংলায় নতুন বছরের শুরুতে পুরান বছরের হিসাব দূর অতীতে মুখে মুখে ও পরবর্তীতে লেখার প্রচলন হওয়ার পর লিখে রাখার রেওয়াজ চালু হয়। হাজার বছরের এই ঐতিহ্য মোটামুটি একটা কাঠামোতে আসে সম্রাট আকবরের মুঘল শাসনামলে।

সে সময় থেকে রাজ-রাজন্যদের হিসাব মেলাতে প্রত্যেক চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাসুল বা কর পরিশোধ করা হতো। এর পরের দিন পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকেরা নিজেদের অঞ্চলের প্রজা বা অধিবাসীদের মিষ্টি, মিষ্টান্ন, পান-সুপারি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। সময়-সুযোগ আর পরিবেশ মিলে যোগ-বিয়োগ ঘটে অনেক ঐতিহ্যের। কিছু ঐতিহ্যের শিকড় এত গভীরে যে আধুনিকতার শত ঝাঁপটায়ও টিকে থাকে প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো। তেমনই একটি হলো হালখাতা।

সর্বজনীন উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ ছিল বাংলা নববর্ষের প্রাণ। পুরোনো বছরের হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলা হয় যে খাতায়, তা-ই ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত।

প্রতিবারের মতো পুরান ঢাকায় এবারও প্রস্তুতি চলছে হালখাতা উৎসবের। তবে এবার রমজান মাসে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হতে যাওয়ায় তা বড় পরিসরে না হয়ে সীমিত আকারে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান সেখানকার ব্যবসায়ীরা।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় সোনার মদিনা জুয়েলার্সের মালিক মো. মাসুমের সঙ্গে। তিনি বলেন, মহামারি এবং রমজানের কারণে অনেকটা ম্লান হয়ে উঠেছে এ অনুষ্ঠান। কারণ বেড়েছে সোনার দাম, যার ফলে ব্যবসায়ী তেমন একটা খুশিতে নেই। তবে অতীত ঐহিত্য ধরে রাখার জন্য সীমিত পরিসরে সবার জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হবে।

এ বিষয়ে তাঁতীবাজারের খাজা জুয়েলার্সের ম্যানেজার খায়রুল আলম অভি বলেন, আগে হালখাতার দিন কয়েক আগে থেকেই ক্রেতাদের বর্ণিল কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ জানাতাম। এখন এক দিকে স্বর্ণের দামের ঊর্ধ্বগতি, আবার রমজান হওয়ার ফলে অনেকেই লেনদেন করবে না। ক্রেতাও তেমন আসছেন না। তবুও খাওয়া দাওয়া মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে হালখাতা খোলার যে আনুষ্ঠানিকতা সেটা পালন করা হবে। তবে তা খুব সীমিত পরিসরে।
হালখাতা উপলক্ষে পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, শ্যামবাজার ও বাবুবাজারের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরেজমিন ঘুরে সীমিত পরিসরে এমন উৎসবের প্রস্তুতি চোখে পড়েছে।

পুরান ঢাকার বড় কিংবা ছোট,সব দোকানেই উৎসব উৎসব ভাব। বেশিরভাগ দোকানে দোকানে রঙ করা থেকে শুরু করে মালামাল পরিষ্কারে নেমেছে মালিকসহ কর্মচারীরা। অনেক ব্যবসায়ী হালখাতা উপলক্ষে বিভিন্ন রঙ দিয়ে দোকানে সাজসজ্জা করছেন। এ ছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি তারা পুরাতন খাতার সব লেনদেনের হিসাবও করছেন। দোকানগুলোতে ক্রেতাদের তেমন ভিড় নেই।

হালখাতা উপলক্ষে ইসলামপুর, বাবুবাজার ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ধোয়ামোছার কাজ করতে দেখা গেছে। সাজিয়ে গুজিয়ে রাখা হচ্ছে দোকানের সরঞ্জাম। অনেক দোকানের ব্যবস্থাপক আমন্ত্রণপত্রের ওপর পাওনাদারের নাম লিখছেন। অনেকে আবার মিষ্টির দোকানে পহেলা বৈশাখের দিনের জন্য মিষ্টির অর্ডার দিচ্ছেন।

পাইকারি কাপড় ব্যবসায়ী সফিকুল ইসলাম জানান, তাদের বাপ-দাদার এ ব্যবসা। একসময় পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাজনা বাজত। গরু, খাসি রান্না হতো দোকানে দোকানে। পর্যাপ্ত মিষ্টি রাখা হতো। এখন ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন উপহার দেন। দোকানের নাম লেখা বিভিন্ন উপহার তৈরি করতে থাকেন মাসখানেক আগে থেকেই। আগের সেই আমেজটা এখন পাওয়া যায় না।

সর্বজনীন উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ ছিল বাংলা নববর্ষের প্রাণ। ১৫৮৪ সালে ১০-১১ মার্চ সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর থেকেই ‘হালখাতা’র প্রচলন হয়। ইদানীং অনেকটা বদলে গেছে হালখাতার রীতিনীতি। একসময় রসগোল্লা, কালোজাম, সন্দেশ, বাতাসা, মণ্ডা, জিলাপি, বুন্দিয়া, লাচ্ছা সেমাই, সুজি, হালুয়া, মুড়ি মুড়কি, দই, চিঁড়া, ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ, গোশত, মাছের মুড়িঘণ্ট, শরবত, বৈশাখী ফল আর খাওয়া শেষে মিষ্টিপান। অনেক সময় দোকানের সামনেই কারিগররা নতুন চুলা বসিয়ে তৈরি করেন গরম গরম জিলাপি, লুচি, বুন্দিয়া আর রসগোল্লা। খদ্দেরদের গরম গরম মিষ্টি খাওয়ানোর উদ্দেশেই দোকানের সামনে এমন ব্যবস্থা করা হতো।