আপডেট : ১৪ এপ্রিল, ২০২২ ১৩:০৮
বাঙালির পহেলা বৈশাখ
উৎসব-সম্প্রীতির মেলবন্ধন
নিজস্ব প্রতিবেদক
দৈনিক ভোরের আকাশ-সবার কথা বলে
বছর ঘুরে এলো বাংলা নতুন বছর, নববর্ষ-১৪২৯। বঙ্গাব্দের প্রথম দিন তথা পহেলা বৈশাখ সকল বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। গুরুত্ববহ এ দিনটি বাংলাদেশে ‘নববর্ষ’ হিসেবে বিশেষ আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে পালিত হয়। বিশ্বের নানা প্রান্তে বসবাসরত বাঙালিরাও এ উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকোৎসব হিসেবে বিবেচিত।
পহেলা বৈশাখের উৎসব সাধারণত শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়ে থাকে। মানুষের মধ্যে শোভা ছড়াতে থাকে বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য- ‘শুভ নববর্ষ’। তা ছাড়া নববর্ষের সময় মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই উৎসব শোভাযাত্রাকে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে। এ ঘোষণা পহেলা বৈশাখের উৎসব-আনন্দকে অনন্য মাত্রা এনে দিয়েছে।
পহেলা বৈশাখ আমাদের সকল সঙ্কীর্ণতা, কূপমূণ্ডকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করে। আমাদের মনের ভেতরের সকল ক্লেদ, জরাজীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যমে বাঁচার অনুপ্রেরণা জোগায়। আমরা যে বাঙালি, আমরা যে বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি- পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়। উপরন্তু, পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকোৎসবও বটে। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয় নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ।
এক সময় নববর্ষ পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির। কারণ কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভর। অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। তখন এটি ছিল পুরোপুরিই অর্থনৈতিক ব্যাপার। অবশ্য চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজো পালিত হয়।
আমাদের মহান স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন শুধু আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী ধারকবাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে।
‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় বিদ্রোহী কবি নজরুল বলেছেন, ধ্বংস আর যুদ্ধ থেকেই নতুনের সৃষ্টি হয়! তেমনই বাংলা নববর্ষের কালবৈশাখী ঝড় বা রুদ্ররূপ থেকেই অনুপ্রেরণা পায় বাঙালি। বাংলাদেশে আমাদের অস্তিত্ব ‘স্বাধীনতা অর্জন’। নয় মাসের যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এতে রক্ত ও সম্পদ বিসর্জন দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার প্রথম মাসেই এসেছিল পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ।
বাংলা নববর্ষ এ দেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্য। এ উৎসবের মধ্য দিয়ে দেশের আপামর জনতা মৌলিক ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে যুগের পর যুগ। একবিংশ শতাব্দীর ‘জটিল’ বিশ্বে এখন এটি সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা ‘মৈত্রী-সম্প্রীতি’র এক উদার মিলনক্ষেত্র। আদর্শ-সম্প্রীতির এ মিলনমেলায় ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সব পেশার, সব শ্রেণির মানুষ ‘একক’ মেলবন্ধনে যুক্ত হয়। এ দৃশ্য পরমানন্দের। গর্বের, গৌরবের।
সবাইকে ‘নববর্ষ ১৪২৯’-এর শুভেচ্ছা।