পহেলা বৈশাখ বাঙালি জীবনের এক চিরায়ত সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের গ্রামীণ উৎসব ছিল মূলত হালখাতা ঘিরে। সারা বছরের দেনা পাওনার হিসাব মেটানো হতো এই দিনে। ব্যবসায়ীগণ বছর শুরুতে পুরোনো হিসাবের খাতার পরিবর্তে নতুন খাতায় হিসাব শুরু করতেন। এই উপলক্ষে ক্রেতা বা খরিদ্দারগণকে দাওয়াত দিয়ে মিষ্টিমুখ করাতেন, যেন নতুন বছর ব্যবসায় আরো উন্নতি বয়ে আনে। শুধু হালখাতা নয়, মেলা বসত কোনো হাটে বা বাজারে। সেখানে মাটির পুতুল, খেলনা তৈজস পত্র, শাড়ি, গামি জিলাপি, দই-মিষ্টি বিক্রি হতো। বিনোদনের জন্য চলত লাঠিখেলা, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি।
সহজ সরল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামে বর্ষবরণের এই আয়োজন হয়ে ওঠে শহরের জীবনের অন্যতম আকর্ষণ। নববর্ষকে বরণে ছায়ানটের উদ্যোগে আয়োজিত সংগীতানুষ্ঠান, আবৃত্তি, আলোচনায় ভোর থেকে মুখরিত হয় ওঠে রমনার বটমূল। এসো হে বৈশাখ এসো এসোÑ সংগীতে কণ্ঠ মেলায় লাখো বাঙালি। সেখানে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষ একাত্ম হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। পান্তা ভাতের বাঙালিয়ানা গ্রামীণ সংস্কৃতির স্বাদ নিতে সবাই বসে যায় শানকি হাতে পান্তা-ইলিশ খেতে।
তবে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজন করে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে চারুকলা বিভাগ থেকে বৈশাখের প্রধান আকর্ষণ হাতি, ঘোরা, ময়ূর, পেঁচা ইত্যাদি জীবজন্তু রাক্কস-খোক্কসের মূর্তি, মুখোশ ও প্রতিকৃতি নিয়ে নববর্ষের শুভ কামনায় বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। অতীত ব্যর্থতার গ্লানি মুছে নতুন বছর বয়ে আনবে মঙ্গল ও সমৃদ্ধি। এই বিশ্বাসেরই প্রতিফলন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’।
১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হলেও ১৯৮৯ সালে বঙ্গাব্দ ১৩৯৬ বর্ষবরণের সময় শিক্ষার্থীদের আয়োজনে প্রথম ঢাকায় শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৯৩ সালের বর্ষবরণ ছিল বঙ্গাব্দ ১৪০০ সালের সূচনা। আর সে উপলক্ষে ‘১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়াসহ আরো বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। চারুকলার সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় দিয়ে শিশু একাডেমি হয়ে আবার চারুকলায় এসে শেষ হয়। ১৯৯৩ সাল থেকেই মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়।
তবে বর্ষবরণের এই প্রাণোচ্ছল আয়োজনকে সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা হয়েছে বার বার। সরকারকে নিতে হয়েছে কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা যেন এসব অনুষ্ঠানে নির্বিঘেœ অংশ নিতে পারে সর্বস্তরের মানুষ। পৃথিবীর বহু দেশই নববর্ষকে তাঁদের নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নানারূপের আয়োজনের মাধ্যমে উদযাপন করে থাকে। কোনো বিশেষ ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক আবরণে নয়। অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে শান্তি, গণতন্ত্র ও বাঙালি জাতিসত্তার ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালি জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তাই পরিচিত।
এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউট মঙ্গল শোভাযাত্রাকে জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কোর কাছে বিশ্ব সাংস্কৃতির ঐতিহ্যের তালিকাভুক্তির অনুরোধ জানায়। অনেক বিশ্লেষণ আর পর্যবেক্ষণের পর ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় শেষ হওয়া ইউনেসকোর ১১তম সভায় ‘স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় কমিটির (ইন্টার গভর্নমেন্টাল কমিটি অন ইনট্যানজিবল হেরিটেজ) ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে ইউনেস্কোর বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ লিস্ট অব ইনট্যানজিয়েবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউমিনিটি’র তালিকায় বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এটা কোনো ধর্মীয় শোভাযাত্রা নয়। এটা হচ্ছে বাঙালির চিরন্তন একটা আনন্দ প্রকাশের এবং নববর্ষকে বরণ করার জন্য শোভাযাত্রা। আমরা সবাই একাত্ম হই এর মাধ্যমে, আমরা সবাই একটা জায়গায় মিলিত হই এবং প্রকৃতিকে আমরা বরণ করি। প্রকৃতির যত প্রতীক আছে এই প্রতীকগুলোকে ভুলভাবে পড়ার কোনো অবকাশ নেই। বাঙালি হতে পারে এটা তাদের মাথায় আসে না। এই যে মঙ্গল শোভাযাত্রা হচ্ছে এটাকে বলা হচ্ছে হিন্দুদের শোভাযাত্রা। তাহলে কেন ভারতের কোনো শোভাযাত্রা ইউনেসকো থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি? বাংলাদেশি শোভাযাত্রাকে কেন স্বীকৃতি দেওয়া হলো?
কিন্তু কেন? ইউনেস্কোর শর্তানুযায়ী এমন কোনো কাজ যা গতানুগতিক নয় বরং কোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের উদ্ভাবিত নিজস্ব কোনো সাংস্কৃতিক কার্যক্রম যা একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো জাতিগোষ্ঠীর মূল্যবোধকে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আন্তঃগোষ্ঠী পর্যায়ে বিনিময়ে সক্ষম। এভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার আরো যে কয়েকটি কারণ রয়েছে তা হলো এই শোভাযাত্রা অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালির ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিগত সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়।
গ্রাম থেকে উৎসারিত নববর্ষ উদযাপনের ধারাবাহিকতায় রাজধানী শহরের একটি নন্দন তাত্ত্বিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের এই রঙিন উদযাপন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির প্রাণের উৎসব। চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের এ শোভাযাত্রা একান্তই শিক্ষার্থীদের প্রাণের পবিত্রতা আর নতুন বৈশিষ্ট্যের শোভাযাত্রা। কোনভাবেই এটি কূপম-ূকতা নয়। এটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত কোনো কুসংস্কার বা সাম্প্রদায়িক চেতনা সংশ্লিষ্ট নয় বরং জাতীয় চেতনার এক উদারনৈতিক বাংলাদেশের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি।
মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্ব সাংস্কৃতির স্বীকৃতি পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় দেশের প্রগতিশীল সমাজ যারা এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে নিয়ে নানা কটূক্তি করেছিল, এটাকে বাঙালি সংস্কৃতি নয় বলে নানাভাবে এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল, বিদ্রুপ করেছিল, অপপ্রচার করেছিল, ধর্মবিরোধী বলেও আখ্যায়িত করেছিল, পুরো পহেলা বৈশাখকে যারা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করেছিল, ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি তাদের সমালোচনার বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাব।
বাংলা নববর্ষকে আপন করে নেয়ার এই বর্ণিল আয়োজন আমাদের হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে শানিত করার প্রাণময় উদ্যোগ। এ উদ্যোগের প্রতি ইউনেস্কোর স্বীকৃতিকে আমরা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। একই সাথে বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ভাণ্ডারে বাংলাদেশের এই অবদানের জন্য আমরা গর্ববোধ করতেই পারি।
লেখক: জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক