গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গা মাটির পথ... কিংবা বাঁশি শুনে আর কাজ নেই সে যে ডাকাতিয়াবাসী এমন বাঁশির সুর ভেসে আসে। বাঁশির কারিগররা কাজের ফাঁকে বাঁশের তৈরির বাঁশিগুলোতে এমন সব গানের সুর তুলেন। এমন সুরের মূর্ছনায় ক্লান্তিদূর হয় তাদের। কুমিল্লা হোমনা উপজেলার প্রত্যন্ত বাঁশির গ্রামটির নাম শ্রীমদ্দি।
প্রায় দুইশ বছর ধরে এ গ্রামে বাঁশ দিয়ে তৈরি বাঁশি বানানো ও বিক্রয় করা হচ্ছে। এই গ্রামের বাঁশি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে চলে গেছে ইউরোপ আমেরিকাতেও। এই গ্রামে বছরজুড়ে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাঁশি বানায় গ্রামটির ৪০ পরিবারের সাড়ে তিনশ সদস্য।
শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশি তৈরির কারিগর আবুল কাশেম। গত ৪০ বছর ধরে তিনি বাঁশি তৈরি করছেন। আবুল কাশেম জানান, বংশ পরম্পরায় এই বাঁশি তৈরি ও বিক্রি করে সন্তানদের লালন পালন করেছেন। গত দুইশ বছর ধরে চলে আসছে বাঁশি তৈরি ও বিক্রির কাজ।
তিনি বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ এলে আমাদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। রাত দিন সমানে চলে বাঁশি তৈরি ও রং করার কাজ। পাইকাররা ভোর থেকেই বাড়িতে এসে বসে থাকেন অর্ডার করা বাঁশি নেয়ার জন্য।’
জানা যায়, চট্টগ্রাম, মিরসরাই, বান্দরবান থেকে বাঁশ সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহ করা বাঁশগুলো প্রথমে রোদে শোকানো হয়। তারপর আকার আকৃতি দিয়ে বাঁশগুলো কাটি হয়। এরপর গরম পানিতে সেদ্ধ করে আকৃতি দেওয়া হয় বাঁশগুলোকে। বাঁশ সেদ্ধ না করলে ঘুনে ধরে বাঁশি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাঁশ সেদ্ধ করার পর কেটে বাঁশি বানানো হয়। বাঁশির ছিদ্র করার জন্য কয়লার আগুনে লোহার শিক গরম করে বাঁশির ছিদ্র করা হয়। এছাড়া এই গ্রামের ঘরের বউ ও মেয়েরা বাঁশি তৈরির কাজে সহযোগিতা করে।
এই শ্রীমদ্দি গ্রামে বিভিন্ন প্রকারের বাঁশি তৈরি হয়। মোহন বাঁশি, বীন বাঁশি, ক্যালেনর বাঁশি, পাখি বাঁশি, নাগিন বাঁশি, আর বাঁশি, সোহন বাঁশি। রকম ভেদে পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে আট হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বাঁশি বিক্রি করা হয় এখানে।
বাঁশির কারিগর আবুল কাশেম জানান, হোমনার শ্রীমদ্দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছায়ানটের শিল্পীরা আসেন। তারা এসে পছন্দ করে বাঁশি কিনে নিয়ে যান।
তিনি তার স্মৃতির ঝাপি খুলে বলেন, ‘আমাদের গ্রাম থেকে বাঁশি কিনে নিয়ে গেছেন শিল্পী বারি সিদ্দিকীসহ আরো বহুগুণি শিল্পীরা।’
বাঁশি কিনতে আসা জামালপুর জেলার ব্যবসায়ী আবদুস সাত্তার বলেন, ‘আমরা যেমন বাঁশি চাই ঠিক তেমন বাঁশি পাই শ্রীমদ্দিতে। বাঁশ সংগ্রহ থেকে শুরু করে বানানো পর্যন্ত সবকিছুতে গুণগত মান অক্ষুণ্ন রাখে কারিগররা।’
ঢাকার সাভার থেকে বাঁশি কিনতে আসা ব্যবসায়ী লুৎফুর বলেন, গত ১০ বছর ধরে পহেলা বৈশাখ এলেই আমি চলে আসি শ্রীমদ্দিতে। এখানকার বাঁশি ঠোঁটে নিলেই যেন সুর বের হয়।
শ্রীমদ্দি গ্রামের বাবুল বিশ্বাস বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছর যাবত বেশ কয়েক বার এনজিওর মাধ্যমে শ্রীমদ্দির বাঁশি পৌঁছে গেছে সিঙ্গাপুর, লন্ডন, কানাডা, আমেরিকা, জার্মান, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশে। সেখানে বসবাসরত বাঙালিরা নিজেরা কিনেন। এছাড়াও বিভিন্ন অর্কেস্ট্রাতেও বাংলাদেশের হোমার বাঁশি বাজানো হয়।’
শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশির কারিগর যতীন্দ্র বিশ্বাস ও তার স্ত্রী রিনা বিশ্বাস বলেন, বাঁশি শিল্পটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের সহযোগিতা লাগবে। সরকার যদি জ্বালানির খরচটা সরবরাহ করতো অথবা সহজ শর্তে ঋণ সরবরাহ করতো তাহলে বাঁশি শিল্পটাকে তারা আরো অনেক দূর নিয়ে যেতে পারতেন।
বাঁশি শিল্পীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুমন দে বলেন, ‘আমি তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন, যদি জ্বালানি হিসেবে গ্যাস সরবরাহ করা হয় তাহলে খুব ভালো হয়। আমি বাখরাবাদ গ্যাসের সঙ্গে কথা বলেছি। হোমনায় লাইন আছে। এখন বাখরাবাদের ডিজিএমের সঙ্গেও বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছি। আশা করি খুব শিঘ্রই ফিডব্যাক পাব।’