logo
আপডেট : ১৫ এপ্রিল, ২০২২ ১০:৩২
বাবা-মার আবেগে তরুণীর সাড়া, পেছাল কানাডা যাত্রা
এম বদি-উজ-জামান

বাবা-মার আবেগে তরুণীর সাড়া, পেছাল কানাডা যাত্রা

প্রতীকী ছবি

‘নিমাই দাঁড়ারে, দাঁড়ারে নিমাই, দেখিবো তোমারে’......এই গানটি গ্রামবাংলার আনাচে কানাচে সকলের হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। নিমাই যখন নিজের মাকে ছেড়ে সন্যাস জীবনে চলে যাচ্ছিল সে সময় তার মায়ের এই আকুতি তুলে ধরে লেখা গানের কলি আজও হৃদয়পটে ভাসে সকলের। ঠিক তেমনি যেন এ যুগের আরেক নিমাই হাজির দেশের সর্বোচ্চ আদালতে।

তবে গানের নিমাইয়ের মতো সন্যাস জীবনে নয়, এবার এক তরুণীর ভিন দেশে চলে যাবার প্রাক্কালে ঔরসজাত পিতা-মাতার আকুতি আদালত কক্ষে উপস্থিত সকলের চোখ ভাসিয়ে দিলো। শেষ পর্যন্ত ক্ষণিকের জন্য জন্মদাতা পিতা-মাতার আবেগের কাছে হার মানলো নিজের ইচ্ছে বা জিদ। বিদায়ের আগে অন্তত ৯৬ ঘণ্টা বরাদ্দ রাখলেন বাবা-মায়ের জন্য। এজন্য আগামীকাল রোববার পর্যন্ত রাজধানীর উত্তর মুগদায় পিতা-মাতার সঙ্গে থাকতে সম্মত হলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক ১৯ বছরের তরুণী।

আপন পিতা-মাতাকে ছেড়ে ভিন দেশে (কানাডা) চলে যেতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়া ওই তরুণীর ক্ষেত্রে তাই ঘটলো। এমন পরিস্থিতিতে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ আগামীকাল রোববার আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছেন। রিট আবেদনকারীরপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম (জেড আই) খান পান্না, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অ্যাডভোকেট মো. শাহীনুজ্জামান ও আয়েশা আক্তার। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস। আর মা-বাবার পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. অজিউল্লাহ ও আজিম উদ্দীন পাটোয়ারী। এছাড়া শুনানির সময় কানাডিয়ান হাইকমিশনের প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন।

কানাডায় যেতে দিতে রাজি না হয়ে রাজধানীর উত্তর মুগদায় পিতা-মাতার বাসায় বন্দি রাখার অভিযোগে ওই তরুণীর পক্ষে করা এক মামলার শুনানিতে গতকাল এমন চিত্র ফুটে ওঠে। গত বুধবার শুনানিকালে আদালতে উপিস্থত ছিলেন ওই তরুণী, তার মা-বাবা, তাদের আইনজীবী ও কানাডিয়ান দূতাবাসের প্রতিনিধি। ওই তরুণীকে মা-বাবা আটকে রেখেছেন-এই অভিযোগে তরুণীকে আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে একাধিক মানবাধিকার সংগঠনের করা রিট আবেদনের ওপর কয়েকদিনের ধারাবাহিকতায় গতকালও শুনানি হয়। আদালতের বিচারপতিদ্বয় একান্তে কথা বলেন তরুণীর সঙ্গে। এরপর এজলাসে বসে আদালত বলেন, ও তো (তরুণী) থাকতে চাচ্ছে না। আজই কানাডায় চলে যেতে চাচ্ছে। এখান থেকেই দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চলে যাবে। তাই আমাদের আজই (রোববার) আদেশ দিতে হবে। তাকে কানাডিয়ান দূতাবাসে পাঠিয়ে দেব।

এ সময় তরুণীর পিতা প্রকাশ্যে আদালতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ও (তরুণী) চলে গেলে যাক, তবে আমি নিজেই ওকে (তরুণী) কানাডায় দিয়ে আসতে চাই। কয়েকটা দিন আমাদের কাছে থাকুক। এসময় তার এই আবেগঘন কথায় আদালত কক্ষে থাকা আইনজীবী-বিচারপতিসহ সকলকে ছুঁয়ে যায়। সকলের চোখ ছলছল করছিল।

তখন আদালত বলেন, আপনারা মেয়ের সঙ্গে কথা বলুন। সে যদি আপনাদের সঙ্গে থাকতে চায়, তাহলে আমরা রোববার আদেশ দিব। অন্যথায় আজই আদেশ দিব। আমরা আড়াইটা পর্যন্ত সময় দিচ্ছি। মা, নানা-নানি আসলে তার সঙ্গে দূতাবাস হয়ে কানাডা যাবার আগে দেখা করতে পারবে।

এরপর তরুণীটির সঙ্গে কথা বলেন তার পিতা। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি আগামী রোববার পর্যন্ত মা-বাবার সঙ্গেই থাকতে সম্মতি জানান। তরুণী নিজেই আদালতে বলেন, আগামী রোববার পর্যন্ত মা-বাবার সঙ্গেই থাকব। এরপর আদালত রোববার পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ধার্য করে বলেন, রোববার কানাডার হাইকমিশনে যাওয়ার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হবে।

এর আগে গতকাল বুধবার সকালে কানাডা হাইকমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশি বাবা-মায়ের সন্তান ১৯ বছরের কানাডিয়ান তরুণীর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা, থাকা খাওয়ার খরচ বহনসহ সব ধরনের নিরাপত্তা দেবে কানাডা সরকার। হাইকোর্টকে লিখিতভাবে কানাডা হাইকমিশনের পক্ষে এ তথ্য জানান আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন।

গত ৫ এপ্রিল রাজধানীর উত্তর মুগদায় ১০ মাস ধরে বাবা-মায়ের বাসায় গৃহবন্দি থাকা ১৯ বছরের কানাডিয়ান তরুণীকে হাজির করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। মুগদা থানার পুলিশ ও তার বাবা-মাকে তরুণীকে হাজির করতে বলা হয়। একইসঙ্গে ১৯ বছরের তরুণীর অসম্মতিতে তাকে ১০ মাস ধরে আটক রাখা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত।

জানা যায়, আলোচিত ওই তরুণীর মা-বাবা কানাডায় থাকতেন। এ সুবাদে মেয়েটির জন্ম কানাডায়। তাই মেয়েটি জন্মসূত্রে কানাডার নাগরিক। কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। ১০ মাস আগে তার বাবা-মা বেড়ানোর কথা বলে তাকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। এরপর ওই তরুণী কানাডায় ফিরে যেতে চাইলেও তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। তরুণীর কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে তাকে তার নানি ও মা সব সময় বাসায় বন্দি করে রাখেন।

এক পর্যায়ে ওই তরুণী ল্যান্ড ফোনে কানাডা সরকার ও ঢাকায় কানাডিয়ান হাইকমিশনকে তাকে জোরপূর্বক ঘরবন্দি করে রাখার কথা জানান। ওই তরুণী কানাডায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানান। এ অবস্থায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মুগদা থানায় কানাডিয়ান হাইকমিশন থেকে সাধারণ ডায়েরি করা হয়। তারপর কানাডিয়ান হাইকমিশনের পক্ষে মানবাধিকার সংগঠন ব্লাস্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র হাইকোর্টে রিট করে। রিট আবেদনে পুলিশের আইজি, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, মুগদা থানার ওসি, ওই তরুণীর বাবা-মাকে বিবাদি করা হয়।