নিজের নাম-পরিচয় পরিবর্তন করে দীর্ঘ ২১ বছর ধরে আত্মগোপনে ছিলেন বহুল আলোচিত রমনা বটমূলে বোমা হামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও একাধিক মামলার পলাতক আসামি মুফতি শফিকুর রহমান।
র্যাব বলছে, আব্দুল করিম নাম ধারণ করে ২০০৮ থেকে নরসিংদীর চর এলাকায় অবস্থিত একটি মসজিদে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা বেতনে ইমামতির চাকরি করেন শফিক। ইমামতির আড়ালে তিনি মানুষের মাঝে ধর্মের নামে বিভ্রান্তিমূলক অপব্যাখ্যা প্রচার করতেন। কৌশলে মাঝে মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতেন তিনি।
শফিকুরকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানে অবস্থানকালীন মুফতি শফিক আফগানিস্তানে চলে যান এবং তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করেন। সেখানে থাকাকালীন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তিনি। এরপর ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে তিনি আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর তিনি ঢাকার খিলগাঁওয়ের একটি মাদরাসায় খণ্ডকালীন শিক্ষকতা শুরু করেন।
শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) দুপুরে কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে তাকে গ্রেপ্তারের পর এসব জানান র্যাব।
তিনি বলেন, ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহতের ঘটনায় জড়িত মুফতি শফিকুর রহমান ওরফে আব্দুল করিম ওরফে শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক (৬১)।
তিনি আরও বলেন, চাঞ্চল্যকর সব মামলার পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করছে র্যাব। এরইমধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অন্যতম পলাতক আসামি জঙ্গি ইকবালকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
র্যাবের এই মুখপাত্র বলেন, ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালীন প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তদের অতর্কিত বোমা হামলায় ১০ জন নিহত এবং আরও অনেকে আহত হন। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রমনা থানায় একটি হত্যা মামলাসহ অপর একটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়। হত্যা মামলায় ২০১৪ সালের ২৩ জুন আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। আর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি বিজ্ঞ দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল-১ এ বিচারাধীন রয়েছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে একটি জনসভা চলাকালে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলা হয়। ওই গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত ও প্রায় তিন শতাধিক গুরুতর আহত হয়। ওই ঘটনায় ঢাকার মতিঝিল থানায় একটি হত্যা ও হত্যাচেষ্টার সহযোগিতাসহ দুটি পৃথক মামলা হয়।
দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং মুফতি শফিকুর রহমানসহ আরও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। গ্রেপ্তার শফিকুর রহমান ওই গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। একই ঘটনায় ঢাকার মতিঝিল থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা অপর মামলারও পলাতক আসামি ছিলেন তিনি।
এছাড়াও ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর থানার বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত এবং কমপক্ষে শতাধিক লোক আহত হয়। ওই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার শফিকুর কিবরিয়া হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি। শফিকুরের বিরুদ্ধে ভৈরব থানায় মোট ছয়টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
গ্রেপ্তার শফিকুর জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, কিশোরগঞ্জের ভৈরবের নিজ গ্রামে ৫ম শ্রেণি পাস করার পর মাদরাসায় পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা চকবাজারের একটি মাদরাসায় পড়াশোনা করেন তিনি।
১৯৮৩ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দাওরায়ে হাদিস (টাইটেল) পাস করে বাংলাদেশে ফেরত আসেন তিনি।
এরপর ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচিতে ইউসুফ বিন নুরী মাদরাসায় ফতোয়া বিভাগে ভর্তি হয়ে তিন বছরের ইফতা (ফতোয়া) কোর্স সম্পন্ন করেন শফিক। করাচির নিউ টাউনে পড়াশোনা করার সময় মুফতি হান্নানের সঙ্গে পরিচয় হয় তার।
আফগানিস্তান থেকে দেশে এসে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) নামে একটি জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলার কাজে দলের অন্য নেতাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন মুফতি শফিক। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে সমমনাদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে হুজিবি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি হুজিবি’র প্রচার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত হুজিবি’র আমির ও ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত হুজিবি’র সুরা সদস্য ছিলেন তিনি।