logo
আপডেট : ১৭ এপ্রিল, ২০২২ ০৮:৩৫
ভয়ংকর হয়ে উঠছে হিযবুত তাহরীর
* টার্গেটে শীর্ষ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা * অনলাইন কনফারেন্স, সামাজিক অনুষ্ঠানে চলছে কার্যক্রম * পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতার পরামর্শ বিশ্লেষকদের
এমদাদুল হক খান

ভয়ংকর হয়ে উঠছে হিযবুত তাহরীর

র‌্যাবের অভিযান গ্রেপ্তার পাঁচজন

ভয়ংকর হয়ে উঠছে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর। মেধাবীদের দলে ভেড়ানোর লক্ষ্যে দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠে কাজ শুরু করেছে এ সংগঠনের জঙ্গিরা। অনলাইন কনফারেন্স, গ্রুপ চ্যাটিং আর সামাজিক অনুষ্ঠানের ভেতরেই সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারা। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, নিষিদ্ধের এক যুগ পেরিয়ে গেলেও হিযবুত তাহরীরের দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। মেধাবী আর বিত্তশালীদের দলে ভিড়িয়ে ইমেজ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে জঙ্গিরা। তাই পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ তাদের।

পুলিশ বলছে, একসময় নিম্নবিত্ত বা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের টার্গেট করলেও এখন জঙ্গিদের প্রধান টাগের্টে পরিণত হয়েছে দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও মেডিকেলের মেধাবী শিক্ষার্থীরা। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ তরুণ আর পারিবারিকভাবে বিত্তশালীদেরও দল ভেড়ানোর চেষ্টা করছে নিষিদ্ধ এ সংগঠনটি।

জানা গেছে, র‌্যাব-পুলিশের গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যেও মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা সক্রিয় থেকে কর্মী সংগ্রহ ও প্রকাশ্য লিফলেট বিতরণ করছে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ এ সংগঠ। শীর্ষনেতারা কারাবন্দি থাকলেও মাঠে থাকা কর্মীরা সংগঠনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

তবে র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র দাবি করে বলেছে, হিজবুত তাহরীর সবসময়ই তাদের নজরদারির মধ্যে থাকে। তবে এর মধ্যেও গোপনে তাদের কিছু কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে বলে খবর তাদের কাছে রয়েছে।

সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ে দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মাথাচাড়া দেয় হিযবুত তাহরীর। পরে সরকারবিরোধী নানা কর্মকাণ্ডের কারণে ২০০৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। গ্রেপ্তার করে হিযবুত তাহরীরের শীর্ষনেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহিউদ্দীন ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজনকে। কিন্তু তারপরও থেমে থাকেনি এদের কার্যক্রম। রাজধানী ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লিফলেট ছড়ানো থেকে শুরু করে প্রকাশ্যই মিছিল পর্যন্ত এরা করে থাকে। শীর্ষপর্যায়ের নেতারা তাদের নানা পরিকল্পনা এদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে থাকে।

হিযবুত তাহরীর পাকিস্তানসহ পৃথিবীর ১৮টি দেশে নিষিদ্ধ। দেশে হিযবুত তাহরীরের ১০টি পাঠচক্র রয়েছে। পাঠচক্রে পাকিস্তান, প্যালেস্টাইন, ইরাক, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের যুদ্ধ, মুসলমানদের ওপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন বিষয়ের ভিডিও ফুটেজ, স্থিরচিত্র ও বিভিন্ন পুস্তিকার মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ছাত্র মুক্তির পাঠচক্রের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের মগজ ধোলাইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

হিযবুত তাহরীর কর্মী ও সমর্থকরা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বিনষ্ট করাসহ দেশকে অস্থিতিশীল করে জনমনে ভীতি সঞ্চার করার উদ্দেশ্যে নাশকতামূলক কার্যক্রমের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থা মনে করছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর উত্তরা, আজমপুর, খিলক্ষেত, বাড্ডা, এয়ারপোর্ট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, রমনা এলাকায় বর্তমানে হিযবুত তাহরীরের বেশি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। বিশেষ করে শুক্রবার জুমার নামাজের পর হিযবুত তাহরীর কর্মীরা এসব এলাকার বিভিন্ন মসজিদে লিফলেট বিতরণ করে। কখনো তারা নিজেরা আবার কখনো ভাড়া করা লোক দিয়ে এ লিফলেট বিতরণ করা হয়।

গত ১৮ মার্চ অনলাইন সম্মেলনের ডাক দেয় নিষিদ্ধঘোষিত এ জঙ্গি সংগঠন। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বুয়েট আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টারিং করে। এছাড়া শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল পুলিশ বক্স। পুলিশ বক্সের চারদিকে একশ গজের মধ্যেই দেখা যায় নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের শ-খানেক পোস্টার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করলেও যেন পুলিশের চোখে পড়েনি ভয়ংকর এ জঙ্গি সংগঠনের প্রচারণা।

অনলাইন সম্মেলনকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে জানিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন বলেন, বড় নাশকতার সক্ষমতা হারিয়েছে হিযবুত তাহরীর। তিরি বলেন, গত ১৮ মার্চ অনলাইন সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে প্রচারণায় নামে হিযবুত তাহরীর। এরপর থেকেই এক যুগ আগে নিষিদ্ধ এ জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রমকে নতুনভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কয়েকদিনের মাথায় আবারো প্রচারণায় নেমে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের হাতে আটক হয় ৪ তরুণ। পরিচয় নিশ্চিতের পর দেখা যায় তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সারির বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী। এছাড়া জঙ্গিবাদের কারণে যেসব শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার আছে, তাদের ডাটা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তারা সবাই প্রায় বিত্তশালী পরিবার থেকে এসেছে।

পুলিশের এ কর্মকর্তা আরো বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল ছাড়াও নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে তারা এ ধরনের (জঙ্গি) কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মিছিল বা সভা-সমাবেশের মতো প্রকাশ্য কার্যক্রমের পরিবর্তে এখন অনলাইন কনফারেন্স, গ্রুপ চ্যাটিং আর সামাজিক অনুষ্ঠানের আড়ালে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে জঙ্গিরা। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির এড়াতে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিপর্যায়ে কাজ করছে তারা।

ফারুক হোসেন আরো বলেন, ‘তারা বাসা বাড়িতে গোপনে যে আস্তানা আছে, যেমন বিভিন্ন শিক্ষার্থীরা যে মেসে থাকে, সেখানে তারা মানুষ থেকে মানুষে উগ্র জঙ্গিবাদ প্রচার করে আসছে।’

তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষক সালাউদ্দিন সেলিম বলেন, ‘বারবার লাইভ সম্প্রচারের প্ল্যাটফরম ও ইউআরএল পরিবর্তনের কারণে অনলাইনে জঙ্গিবাদী তৎপরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না।’

নিষিদ্ধ ঘোষণার এক যুগের বেশি সময় পরও হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম বন্ধ না হওয়া দেশের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি- বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার।

ডিএমপির কাউন্টার টেররিজমের উপপুলিশ কমিশনার আব্দুল মান্নান বলেন, নিষিদ্ধ সব সংগঠনই গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারিতে থাকে। সেক্ষেত্রে হিযবুত তাহরীর ও জেএমবিও রয়েছে। তিনি বলেন, অনলাইনে সম্মেলনের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা ইতোমধ্যে নজরদারি করছি। অনেক সময় দেশের বাইরে বসেও জঙ্গিরা এ ধরনের সম্মেলন করে। তারপরও যদি দেশের কোথাও এ সম্মেলন করার চেষ্টা করে তবে আমাদের নজরদারির মধ্যে থাকবে।

তিনি আরো বলেন, ‘এ সংগঠন দুটির কার্যক্রম অমাদের নজরদারির মধ্যে থাকে। যখনই এরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখনই গ্রেপ্তার হয়’। তবে এ মুহূর্তে তাদের সাংগঠনিক অবস্থা কী- এমন প্রশ্নে তিনি দাবি করে বলেন, ‘যেহেতু তারা নজরদারির মধ্যে রয়েছে, সেহেতু তাদের নাশকতা বা রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ কোনো কিছু করার মতো শক্তি তাদের নেই। তারপরও আমরা এ বিষয়গুলো দেখছি।’

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, হিযবুত তাহরীরের কর্মকাণ্ড তারা নজরদারির মধ্যে রেখেছেন। হিযবুত তাহরীরের এখন যারা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন, তাদের গ্রেপ্তারে র‌্যাবের বিশেষ টিমও কাজ করছে।

অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘শীর্ষ মেধাবীদের নিজেদের দলে ভিড়িয়ে ইমেজ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে হিযবুত তাহরীর। উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা থেকে সচেতনতার অভাবে জঙ্গিরা এখনো তরুণদের বিভ্রান্ত করেই যাচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘একজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে তারা যদি দলে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে, তখন সেটা তাদের জন্য সহানুভূতি তৈরি হবে। তাদের প্রতি অন্যদের সহানুভূতির মাত্রাটা বেড়ে যাবে। তারা তখন বোঝাতে চায়, আমাদের দলে শুধু নিম্নবিত্ত নয়, উচ্চবিত্তরাও আছেন। আমাদের মতাদর্শে শুধু নিম্নবিত্তরা নয়, উচ্চবিত্তরাও এ মতাদর্শে বিশ্বাস করে।’ এছাড়া আইন প্রয়োগের পাশাপাশি ডি-র‌্যাডিকালাইজেশন প্রক্রিয়া জোরদার করতে না পারলে শুধু আটক করেই উগ্রবাদবিরোধী অভিযান ফলপ্রসূ হবে না বলেও মনে করেন এ অপরাধ বিশ্লেষক।