উন্নত দেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের বিদেশে বিনিয়োগ ও ব্যবসা করার সুযোগ বাড়াতে নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ-সংক্রান্ত খসড়া নীতিমালা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। তবে নীতিমালায় যেসব দেশ থেকে মুনাফা দেশে আনার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ নেই, শুধু সেসব দেশেই বিনিয়োগ করার অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি রাখা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে। আর বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই যাতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার না হয়, সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৪৭ এর আওতায় খসড়া নীতিমালায় বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিদেশে বিনিয়োগ নীতিমালায় দেশের রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীদের বিদেশে সহযোগী প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য গত ৫ বছরের বার্ষিক গড় রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করার সুযোগ রাখা হবে। তবে সরকারি অনুমোদনসাপেক্ষে এ নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত দেশের ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে সহযোগী প্রতিষ্ঠান বা অফিস খোলার অনুমতি দিয়েছে। জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের ৫টি প্রতিষ্ঠানকে ভারত, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও সৌদি আরবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, ফার্মাসিউটিকালস ও খেজুরের ব্যবসায় বিনিয়োগ করার অনুমতি দিয়েছে। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরো ১০টি প্রতিষ্ঠানকে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইথিওপিয়া ও কেনিয়ায় সহযোগী প্রতিষ্ঠান খোলার অনুমতি দিয়েছিল।
সূত্র জানায়, এ নীতিমালায় বাংলাদেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিদেশে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ হিসেবে সহযোগী প্রতিষ্ঠান তৈরি কিংবা কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনার সুযোগ রাখা হবে। আর বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রপ্তানি থেকে অর্জিত আয়ের একটি অংশ এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটা (ইআরকিউ) অ্যাকাউন্টে রাখতে হবে। বিদেশে বিনিয়োগের যোগ্যতা অর্জনের জন্য বিনিয়োগকারী ও রপ্তারিনকারকদের ইআরকিউ অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট পরিমাণ স্থিতি থাকাও বাধ্যতামূলক হবে। এছাড়া নীতমালায় ঋণখেলাপিরা বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ পাবেন না- এমন বিধান রাখা হচ্ছে।
জানা গেছে, খসড়া নীতিমালায় রপ্তানিকারকদের সর্বশেষ নিরীক্ষিত বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো নিট সম্পদের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হতে পারে। এছাড়া বিদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোকে রপ্তানিমূল্য প্রত্যাবাসনের সনদ ও আমদানি দায় নিষ্পত্তির সনদও জমা রাখতে হবে। খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, বিনিয়োগ গন্তব্য নির্বাচনে শর্ত থাকবেÑ যেসব দেশে মুনাফা প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ নেই, শুধু সেসব দেশেই বিনিয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হবে। এছাড়া যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি রয়েছে, সেসব দেশে বিনিয়োগকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। পাশাপাশি যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় পুঁজি বিনিয়োগ, উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ চুক্তি আছে, সেদেশগুলো অগ্রাধিকার পাবে।
জানা গেছে, বিদেশে বিনিয়োগ নীতিমালায় যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, সেসব দেশে বিনিয়োগের অনুমোদনের সুয়োগ রাখা হবে না। এছাড়া যেসব দেশের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং বৈদেশিক সম্পদ নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের নিষেধাজ্ঞা আছে সেসব দেশে বিনিয়োগের কোনো প্রস্তাব অনুমোদন করা হবে না। আর নীতিমালার খসড়ায় বিদেশে বিনিয়োগের অর্থ সরাসরি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠানোর প্রস্তাব থাকছে। এছাড়া যদি কোনো কারণে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ সম্ভব না হয়, তাহলে দেরি না করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বানুমতি ছাড়া আয়, লভ্যাংশ, মুনাফা অথবা শেয়ার বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ পুনর্বিনিয়োগ করা যাবে নাÑ এমন বিধানও রাখা হচ্ছে নীতিমালায়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে জানান, অর্থ পাচার, সন্ত্রাসী অর্থায়ন এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মালিক-কর্মচারীদের স্থানীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতি অবমাননাকর আচরণ ও মন্তব্য এবং বর্ণবাদী আচরণ ও কার্যকলাপের বিষয়ে সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে শূন্য সহনশীলতার নীতিও অনুসরণ করতে হবে- নীতিমালায় এমন বিধান রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের কর্মী হিসেবে সর্বোচ্চসংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়োগ করার বিধান রাখা হবে। তবে বিদেশে বিনিয়োগ নীতিমালা সরকারি অনুমোদনসাপেক্ষে চূড়ান্ত করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জানা গেছে, বিদেশে বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশ ব্যাংক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায় পরিবেশ বিষয়ক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিধান থাকবে। এছাড়া নীতিমালায় সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যেকোনো সময় বিদেশে স্থাপিত সহযোগী প্রতিষ্ঠান সরেজজিন পরিদর্শন করতে পারবে এবং বিনিয়োগকারীদের সেই পরিদর্শনের খরচ বহন করতে হবে- এমন বিধানও রাখা হবে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকতে আন্তঃদেশীয় বিনিয়োগ এখন বিশ্ব বাস্তবতা। তবে বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে; যাতে দেশ থেকে কোনোভাবেই বিদেশে অর্থ পাচার না হয়। যে নীতিমালাই করা হোক, তাতে দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগের অপব্যবহার এবং সংশ্লিষ্ট বিধিমালা লঙ্ঘন করা হলে তা অর্থ পাচার ও মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এবং বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৪৭ এর বিধান অনুযায়ী এ ধরনের অপরাধে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক ও সংশ্লিষ্টরা শাস্তিযোগ্য হবেন বলেও আইনে উল্লেখ আছে।