মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ দূত রাশাদ হোসাইন চার দিনের সফরে গতকাল রোববার ঢাকায় এসেছেন। সফরের প্রথম দিনই বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তাদের কার্যালয়ে মতবিনিময় করেছেন তিনি। এ সময় তিনি বাংলাদেশের ধর্মীয় স্বাধীনতা পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের কাছে জানতে চান।
রাশাদ হোসাইন তার সফরের দ্বিতীয় দিন আজ সোমবার (১৮ এপ্রিল) সকালে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন এবং আগামীকাল মঙ্গলবারও রেহিঙ্গা শিবিরে কাটাবেন। সেখানে তিনি তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনবেন। এছাড়া অন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার মানবিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি।
মঙ্গলবার ঢাকায় ফিরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী এনামুল হাসান এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব আখতার হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে বাইডেনের এই উপদেষ্টার। এছাড়া মন্ত্রী, সচিব, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সরকারের ডজনখানেক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে রাশাদ হোসাইনের।
তার আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতেই রাজধানীর ইস্কাটনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস) মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধি, কূটনীতিক এবং গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাশাদ হোসাইনের এ সফরকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই নিচ্ছে সরকার। তার সফরের আগে সাম্প্রতি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ৭৪ পৃষ্ঠার একটি মার্কিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের ১৯০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতি বছর প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট। ওই প্রতিবেদনের বিভিন্ন অংশ ও বিষয়বস্তুতে বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যাপক অসঙ্গতির তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে, যা তুলে ধরবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সফরের আগে গত শনিবার এবিসি নিউজকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বিশেষ দূত রাশাদ হোসাইন বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বত্র সব মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারকে সমর্থন করে। হোয়াইট হাউজ রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, একটি রাষ্ট্রহীন মুসলিম সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ করে উদ্বিগ্ন।’
তিনি বলেন, ‘যারা নির্যাতিত হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন যেকোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়িয়েছে। নৃশংসতা যাতে না ঘটে, তার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব। এ কাজের গভীর দিকগুলোর মধ্যে একটি হলো এটি আমাদের দায়িত্ব, যা আমরা খুব গুরুত্ব সহকারে নেই।’
মার্কিন প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, উত্থাপিত কিছু অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে, যার মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, সরকারি এজেন্টদের দ্বারা নিষ্ঠুর এবং অবমাননাকর আচরণ, নির্যাতন, মামলা, প্রাণনাশেন হুমকি, নির্বিচারে আটক, রাজনৈতিক কারণে বন্দি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিশোধ, বিচার বিভাগকে চাপে রাখা, স্বেচ্ছাচারী বা বেআইনি হস্তক্ষেপ, একজনের অপরাধে পরিবারের অন্য সদস্যকে হয়রানি ও সাংবাদিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন রয়েছে।
অযৌক্তিক গ্রেপ্তার, সেন্সরশিপ আরোপসহ মতপ্রকাশ এবং মিডিয়ার ওপর গুরুতর বিধিনিষেধ, ইন্টারনেট ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, তদন্ত ও জবাবদিহিতার অভাব, যৌন সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, বাল্য ও জোরপূর্বক বিবাহসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের আরো কিছু অভিযোগ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এছাড়া জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা আদিবাসীদের লক্ষ করে সহিংসতার হুমকি, লেসবিয়ান, সমকামী, ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার সুরক্ষার পথে প্রতিবন্ধক আইনের অস্তিত্ব বা ব্যবহার বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনে। বৈঠকে এসব বিষয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে ব্রিফ করা হবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ দূতকে।
কূটনৈতিক সূত্র এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, বিশেষ করে সমকামিতার বৈধতা প্রশ্নে অবস্থান পাল্টাবে না বাংলাদেশ। এমনকি এ ইস্যুতে যতটাই চাপ আসুক না কেন, তা সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি ঢাকার রয়েছে। জনগণের বিরুদ্ধে যায়, এমন কিছু যে ঢাকার তরফে করা একদমই সম্ভব হবে না, সেটিও তুলে ধরা হবে বৈঠকে।
মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে বেশকিছু অংশকে ভুলভাবে উপস্থাপনের দাবি করে তা নাকচ করে দিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। তিনি বলছেন, কারণ এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বিরোধিতা করা হবে। ধর্মের বিরোধিতা করা হবে।
বাংলাদেশের আইনানুযায়ী, সমকামিতা একটি ফৌজদারি অপরাধ। মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই আইনের ফলে এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘এ রিপোর্টে সমকামিতার বৈধতা নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি বলা হয়েছে। আপনি একটি মুসলিম দেশ দেখান, যেখানে সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এটি আমাদের ইসলাম ধর্মের পরিপন্থি এবং আমার ধারণা এটা সব ধর্মের পরিপন্থি।’
মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত (অ্যাম্বাসেডর এট লার্জ) হওয়ার আগে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের অংশিদারত্ব এবং গ্লোবাল এনগেজমেন্ট ডিরেক্টরেটের পরিচালক ছিলেন রাশাদ হোসাইন। সিনিয়র কাউন্সেল, অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনে (ওআইসি) কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। কৌশলগত সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ বিষয়ক মার্কিন বিশেষ দূত এবং হোয়াইট হাউজের ডেপুটি অ্যাসোসিয়েট কাউন্সিলর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন রাশাদ হোসাইন।