ঘড়িতে তখন ৬টা ১৮ মিনিট। মাত্র পাঁচ-ছয় মিনিট পরই মাগরিবের আজান। বাসে ঝুলন্ত অবস্থা দাঁড়িয়ে হকার থেকে কেনা পানি আর জুস দিয়েই ইফতার সারলেন তৈয়বুর রহমান (৩৫)। বাসা রামপুরার ওয়াপদা রোডে। তৈয়বুর রহমান কাজ করেন আকাশ পরিবহণ (ঢাকা-মেট্র-ব-১৩-০২৭১) বাসের হেল্পার হিসেবে।
গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে বাসটি সদরঘাট থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। রামপুরা ব্রিজ থেকে তার ডিউটি পরিবর্তন হবে। পরে বাসায় গিয়ে ইফতার করবেন পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু বিজয়নগর পর্যন্ত আসতেই ইফতারের সময় হয়ে গেছে। ভেবেছিলেন ইফতারের আগে বাসায় পৌঁছে যাবেন। তার সেই ভাবনার গুড়েবালি করে দিল রাজধানীর সড়ক এবং যানজট। বাসে পঁয়তাল্লিশ মিনিট বসে থেকেও গুলিস্তান থেকে কাকরাইল মোড় পার হতে পারেননি।
কোথায় ইফতার করা হয় এবং ইফতারে কি খাওয়া হয়- এমন প্রশ্ন করা হয়। জবাবে তিনি বলেন, ‘খুব কমই পরিবারের সঙ্গে ইফতার করতে পারি। বেশির ভাগ সমই রাস্তায় ইফতার করতে হয়। পানি আর টুকটাক যা পাই তা দিয়াই ইফতার সাইরা লই। অনেক সময় রোজাও রাখতে পারি না। সারাদিন চিল্লাইয়া লোক ডাকতে হয়, তাই গলা শুকাইয়া যায়। তাই মাঝে মধ্যে কিছু রোজা ভাঙন লাগে।’
ইফতারির ঠিক আগমুহূর্তে পল্টন, প্রেসক্লাব বিজয়নগর হয়ে আবুল হোটেল পর্যন্ত বাসের সারি। যানজটে আটকা পড়েছেন বাসের সঙ্গে অসংখ্য রোজাদার। কেউ বাসের সিটে বসে আছেন, আবার অনেককেই দেখা যায় বাসে ঝুলে আছেন। হাতে পানির বোতল বা হাল্কা কিছু ইফতারি নিয়ে। এসব মানুষের বেশির ভাগকেই ইফতার করতে হয় বাসেই।
রমজানের ১৫তম দিন গতকাল রোববার বিকেলে সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে ঘরমুখো মানুষের এমন ভোগান্তির চিত্র ওঠে আসে। দুপুরের পর থেকেই রাজধানীতে যানবাহনের লম্বা সারি দেখা যায়। ইফতারির আগমুহূর্ত পর্যন্ত তীব্র যানজট সৃষ্টি হয় রাজধানীজুড়েই। অনেকেই বাসায় পৌঁছাতে না পেরে বাসে বা রাস্তায় ইফতার করেন।
বাসায় ফিরে ইফতার করতে চাওয়া মানুষের কর্মক্ষেত্র থেকে বের হওয়ার পর শুরু হয় গণপরিবহণের জন্য অপেক্ষা। ভাগ্য ভালো হলে অনেকেই বাসে উঠে ঝুলে থাকার মতো জায়গা পায়; অন্যথায় শুধুই অপেক্ষা। তবে রমজান এলেই এ চিত্র যেন ব্যাপক আকার ধারণ করে।
রাজধানীর মতিঝিল থেকে মিরপুরগামী বিকল্প বাসের যাত্রী নাসিফ খান। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। পানির বোতল হাতে নিয়ে বাসের জানালার সারির সিটে বসে ছিলেন। রাস্তায় তখন প্রচুর যানজট। বাসটি দৈনিক বাংলা মোড় থেকে যাত্রা শুরু করলেও বিশ মিনিটে তা তখনো প্রেসক্লাব অতিক্রম করতে পারেনি।
নাসিফ খানের সঙ্গে ভোরের আকাশের কথা হলে তিনি জানান, ‘ইফতারির আগে প্রতিদিনই এমন জ্যাম লেগে থাকে। খুব কমই বাসায় গিয়ে ইফতার করতে পারি। তাই এভাবে পানি দিয়েই ইফতার করতে হয়। অফিস সময় শেষে হিসাব-নিকেশ শেষ করে বাসার উদ্দেশে বের হতে একটু দেরি হয়ে যায়। যে কারণে মতিঝিল থেকে বাসে উঠে যানজটের সঙ্গে যুদ্ধ করে ফার্মগেটে পৌঁছার আগেই ইফতারির সময় হয়ে যায়।’
অফিস শেষে রাজধানীর পল্টন মোড় থেকে (ঢাকা মেট্র-ব-১৫-৩৬১৪) সিরিয়ালের ভিক্টর ক্লাসিক বাসে করে কুড়িল যাচ্ছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী মহিবুল্লাহ। তিনি বলেন, পল্টন মোড় থেকে কাকরাইল পর্যন্ত এবং শান্তিনগর থেকে ফ্লাইওভারের আবুল হোটেলের অংশ পর্যন্ত তীব্র যানজট লেগে থাকে। এরপর বাড্ডা এলাকায় তো যানজট আছেই। ইফতারির আগ পর্যন্ত প্রতিদিনই এ অবস্থা। একদিনও সময়মতো গিয়ে ইফতারি করতে পারি না। প্রতিদিন যদি এত সময় যানজটে পড়ে থাকতে হয়, তা হলে অন্য কাজ করব কখন? কারো কি এসব বিষয় চোখে পড়ে না?