logo
আপডেট : ১৮ এপ্রিল, ২০২২ ২১:৩৪
অনলাইনে প্রতারণার ফাঁদ
নতুন কাপড় অর্ডার করলে পাওয়া যেত ছেঁড়া কাপড়!
নিজস্ব প্রতিবেদক

নতুন কাপড় অর্ডার করলে পাওয়া যেত ছেঁড়া কাপড়!

অনলাইনে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণার অভিযোগে ৫ প্রতারককে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ।

অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে এবং পণ্যের স্বাভাবিক দামের চেয়ে অনেক কম দামের অফার দেখে পণ্যের অর্ডার করে হরহামেশাই ঠকছেন ব্যস্ত শহর রাজধানী ঢাকার মানুষ। ঢাকার বাইরেও এমন অর্ডার আসছে অহরহ। কিন্তু, ডেলিভারি নেওয়ার পর খারাপ পণ্য পেলে তা ফেরত নিতে অস্বীকার করে প্রতারক সরবরাহকারীরা। এভাবে প্রতারিত হওয়ার পর প্রতিকার না পেয়ে লোকলজ্জায় বা সম্মানহানির ভয়ে অনেকেই মামলাও করতে চান না। এ কারণে পার পেয়ে যায় প্রতারকচক্রের সদস্যরা। তবে সবসময় একই ঘটনা ঘটবে তাও নয়। টানা ৬ বছর প্রতারণা করা এমন একটি প্রতারকচক্রের বিরুদ্ধে এক ব্যক্তি মামলা করায় তাদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

ডিবি পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি করা একটি সাধারণ ডায়েরির (জিডি) ওপর ছায়া তদন্ত করে এমন একটি চক্রকে আটক করতে সক্ষম হয়েছেন তারা।

এই চক্রটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ২১টি পেজ খুলে বিভিন্ন পণ্যের চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে আসছিল। এসব বিজ্ঞাপনে বিশাল মূল্য ছাড়ের ঘোষণা দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা হত। ক্রেতারা পণ্যের অর্ডার দিলে কুরিয়ারে ডেলিভারিও দিতো চক্রটি। ডেলিভারি পাওয়ার পরই ঘটতো বিপত্তি। ক্রেতা প্যাকেট খুলে দেখতেন ‘অর্ডার করা পণ্য নয়, প্যাকেটে থাকতো ব্যবহার অযোগ্য ছেঁড়া কাপড়। চক্রটি এভাবেই প্রতারণা করে আসছিল দীর্ঘদিন। অর্ডার করা পণ্য না পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চক্রটির সঙ্গে যোগাযোগ করতেন ক্রেতারা। তখন ক্রেতাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ শুরু করে দিত চক্রটি।

প্রতারিত হওয়ার পর যখন ক্রেতারা চক্রটির কাছে জানতে চাইতো অডার্র করা পণ্য না দিয়ে কেন বাজে পণ্য দেওয়া হয়েছে। ক্রেতার এমন অভিযোগের পর চক্রটির সদস্যরা খারাপ আচরণ শুরু করে ক্রেতাদের মোবাইল নম্বর ও ফেসবুক আইডি ব্লক করে দিতো। যাতে প্রতারিত হওয়া কোনো ক্রেতা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পারেন। এরা এভাবে প্রায় প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতো।

এছাড়া ক্রেতাদের মোবাইল নম্বর ও ফেসবুক আইডি ব্লক করে দিত চক্রটি। অবশেষে ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে এই চক্রের ৫ সদস্য।

এরা হলো- চক্রের মূলহোতা মো. বাপ্পি হাসান (২৪), মো. আরিফুল ওরফে হারিসুল (১৯), মো. সোহাগ হোসেন (২২), মো. বিপ্লব শেখ (২৫) ও নুর মোহাম্মদ (২৮)।

গত রোববার রাতে হাজারীবাগ থানাধীন শঙ্কর এলাকার একটি ভবনের ফ্ল্যাট থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ব্যবহার অযোগ্য ও অতি নিম্নমানের পুরাতন ও ছেঁড়া শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রি-পিসসহ বিভিন্ন পণ্য উদ্ধার করা হয়।

সোমবার সকালে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) রাজীব আল মাসুদ সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।

তিনি জানান, অনলাইনে প্রতারণা চক্রের দলনেতাসহ পাঁচজনকে রাজধানীর হাজারীবাগ থানা এলাকার পশ্চিম ধানমণ্ডি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হাজারীবাগ থানার পশ্চিম ধানমন্ডির একটি বাড়িতে বসে এই অনলাইন প্রতারক চক্রের সদস্যরা ফেসবুকে পেজ খুলে ভালো মানের পণ্যের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেয়। বিজ্ঞাপন দেখে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অর্ডার আসে। চক্রটি অর্ডার পাওয়ার পর মানুষকে নিম্নমানের, ব্যবহারের অযোগ্য ও নষ্ট মালামাল কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠায়।

তিনি বলেন, সম্প্রতি ডিএমপির পল্টন থানায় এক ভুক্তভোগী এ সংক্রান্ত একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডির পর থেকেই এ বিষয়ে ছায়া তদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের লালবাগ বিভাগ। গোয়েন্দা নজরদারির ভিত্তিতে রোববার রাতে এ চক্রের পাঁচ সদস্যকে আটক করা হয়। আটক সবার গ্রামের বাড়িই নড়াইলে। চক্রটির আরও একটি গ্রুপ নড়াইলে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

আরও জানা যায়, চক্রটি প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০টি পার্সেল পাঠাতেন। এভাবে চক্রটি মাসে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা আয় করতো। গত পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে চক্রটি এই প্রতারণা করে আসছিল। চক্রটির সঙ্গে এসএ পরিবহনের লোকজনও জড়িত রয়েছে।

ডিবি কর্মকর্তা রাজীব আল মাসুদ আরো জানান, চক্রটি গত পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে তাদের এ প্রতারণা ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। চক্রটি ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ খুলে আকর্ষণীয় পণ্য বিশেষ করে নারীদের পোশাকের চকটকদার বিজ্ঞাপন দিতো। স্বাভাবিক মূল্যের অনেক কম মূল্য লিখে তারা এসব পোশাকের বিজ্ঞাপন দিয়ে আসছিল। ক্রেতারা আকৃষ্ট হয়ে তাদের কাছে পণ্যের অর্ডার দিতেন। তারা কুরিয়ারের মাধ্যমে ডেলিভারি দিতো। কিন্তু ডেলিভারিতে কখনো গ্রাহকের অর্ডার করা পণ্য দিতো না চক্রটি। ডেলিভারিতে তারা ব্যবহারের অযোগ্য ও ছেঁড়া কাপড় দিত।

তিনি আরও বলেন, প্রতারিত হওয়ার পর যখন ক্রেতারা চক্রটির কাছে জানতে চাইতো অডার্র করা পণ্য না দিয়ে কেন বাজে পণ্য দেওয়া হয়েছে। ক্রেতার এমন অভিযোগের পর চক্রটির সদস্যরা খারাপ আচরণ শুরু করে ক্রেতাদের মোবাইল নম্বর ও ফেসবুক আইডি ব্লক করে দিতো। যাতে প্রতারিত হওয়া কোনো ক্রেতা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পারেন। এরা এভাবে প্রায় প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতো।

আটকরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, গত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে তারা এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। এরা কুরিয়ার সার্ভিস এসএ পরিবহনকে ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় প্রতারণা করেছে।

ডিবি ডিসি রাজীব আল মাসুদ বলেন, আমরা তাদের ২১টি ফেসবুক পেজের সন্ধান পেয়েছি। এর মাধ্যমে তারা প্রতারণা করে আসছিল। আমরা ১৭৭টি খারাপ শাড়ি, থ্রি-পিস জব্দ করেছি। এসব কাপড় সাধারণত বাসা বাড়িতে ব্যবহারের পর অনেকে বিক্রি করে দেয় বা মানুষকে দিয়ে দেয়। চক্রটি এসব কাপড় কিনে মানুষকে ডেলিভারি দিতো ভালো পণ্যের নামে।

এক প্রশ্নের জাবাবে ডিবি লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) রাজীব আল মাসুদ বলেন, প্রতি মাসে তারা এভাবে প্রতারণা করে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা আয় করতো। গত পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে তারা এই প্রতারণা করে আসছিল।

আটকরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, গত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে তারা এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। এরা কুরিয়ার সার্ভিস এসএ পরিবহনকে ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় প্রতারণা করেছে।

এসএ পরিবহনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ডিবি লালবাগ বিভাগের ডিসি রাজীব আল মাসুদ বলেন, এসএ পরিবহনের সঙ্গে চক্রটির একটি চুক্তি রয়েছে। সেই অনুযায়ী চক্রটির পার্সেল তারা পাঠাতো। এছাড়া এসএ পরিবহনের লোকজন জানতো চক্রটি এসব খারাপ মালামাল ক্রেতাদের পাঠায়। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি পার্সেল ৫০ টাকা করে নিত তারা।

তিনি বলেন, আমরা এসএ পরিবহনের কয়েকজনের নাম পেয়েছি, যারা এই প্রতারণার বিষয়টি জানেন। আমরা তাদেরও আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।

ক্রেতারা অল্প টাকার প্রতারণার শিকার দীর্ঘদিন ধরে তারা এমন প্রতারণা করেও কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল--এমন প্রশ্নের জবাবে ডিসি ডিবি লালবাগ বলেন, অল্প টাকার প্রতারণায় অনেকেই থানায় যেতে চান না, বিষয়টি ঝামেলা মনে করেন। আমরাও অনেক ভুক্তভোগীকে মামলার করার জন্য বলেছি, কিন্তু তারা রাজি হননি। এ কারণে প্রতারকরা আরও উৎসাহী হয় যে ভুক্তভোগীরা প্রতারিত হলেও মামলা করতে রাজি হয় না।

তিনি বলেন, বিশেষ করে ঈদের সময় রাস্তাঘাটে যানজট রয়েছে। এ কারণে অনেক ক্রেতাই অনলাইনে ঝুঁকে পড়ছেন। ঈদের সময় অনেকেই অনলাইন কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তাই চক্রটি এ সুযোগটা গ্রহণ করে। ঈদকে সামনে রেখে আমাদের একার পক্ষে এ চক্রগুলোকে মনিটরিং করা সম্ভব না। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে মনিটরিং করতে হবে।