অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ ‘দারকিনা’ মাছটি এক সময় দেশের যেকোনো জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। জলাশয় সংকোচন, পানি দূষণ এবং অতি আহরণের ফলে মাছটির বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস হয়েছে।
তাই বর্তমানে এ মাছটি বাংলাদেশে বিপন্নের তালিকায়। ফলে দীর্ঘ গবেষণায় মাছটির কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) একদল বিজ্ঞানী।
গবেষণা দলের প্রধান ছিলেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আউয়াল। এছাড়া সহযোগী গবেষক ছিলেন ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আশিকুর রহমান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শাহা আলী।
ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, মাছটিকে স্থানীয়ভাবে দারকিনা, ডাইরকা, ডানখিনা, দাড়কিনা, ডানকানা, দারকি, দারকা, চুক্কনি, দাইড়কা ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। মাছটি দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত (গাঙ্গেয় প্রদেশ ও আসাম), মিয়ানমার, পাকিস্তান, নেপাল ও থাইল্যান্ডে পাওয়া যায়।
বহুল পরিচিত ও সুস্বাদু এ মাছটি এখন বিলুপ্তির পথে। এজন্য মাছটি খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে ২০২১ সালের শুরুতে গবেষণা চলে। গবেষণার ধারাবাহিকতায় গত মার্চ মাসের শেষ দিকে ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহস্থ স্বাদুপানি কেন্দ্রে এ মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা পাওয়া যায়।
মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শাহা আলী দৈনিক ভোরের আকাশকে জানান, এই মাছের কৃত্রিম প্রজননের জন্য গত মার্চ মাসের শেষ দিকে পরিপক্ব স্ত্রী ও পুরুষ মাছ নির্বাচন করে পুকুর থেকে তা সংগ্রহ করা হয়। প্রজনন মৌসুমে পরিপক্ব স্ত্রী মাছের পেট ফোলা ও নরম দেখে শনাক্ত করা হয়।
পরিপক্ব স্ত্রী মাছের জননেন্দ্রীয় গোলাকার ও ফোলা হয়, কিন্তু পুরুষ মাছের জননেন্দ্রীয় পেটের সঙ্গে মেশানো, লম্বাটে ও ছোট হয়। কৃত্রিম প্রজননের ৫-৬ ঘণ্টা পূর্বে স্ত্রী ও পুরুষ মাছ (১ দশমকি ৫-৩ গ্রাম) পুকুর থেকে সংগ্রহ করে হ্যাচারির সিস্টার্নে রাখা হয়। এরপর কৃত্রিম প্রজননের জন্য স্ত্রী ও পুরুষ দারকিনা মাছকে পিজি হরমোন ইনজেকনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়।
তিনি বলেন, ইনজেকশন দেওয়ার পর স্ত্রী ও পুরুষ মাছ ১ অনুপাত ১ দশমিক ৫ অনুপাতে সিস্টার্নে স্থাপিত নটলেস হাঁপায় রাখা হয় এবং অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ঝর্ণার মাধ্যমে পানির প্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়। ইনজেকশন দেওয়ার ৬-৭ ঘণ্টা পর স্ত্রী মাছ ডিম দেয়।
গবেষণার ধারাবাহিকতা উল্লেখ করে ড. মো. শাহা আলী বলেন, এ মাছের ডিম আঠালো প্রকৃতির না হওয়ায় হাঁপার নিচের দিকে লেগে থাকে। ডিম দেওয়ার পর ব্রুড মাছকে হাঁপা থেকে দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হয়। ডিম দেওয়ার ১৪-১৬ ঘণ্টার মধ্যে নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু বের হয়ে আসে। ডিম থেকে রেণু বের হওয়ার পর হাঁপাতে ৪৮-৭২ ঘণ্টা রাখতে হয়।
তিনি বলেন, হাঁপা থেকে ডিমের খোসা ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে সাইফনিং করে সরিয়ে ফেলতে হয়। রেণুর ডিম্বথলি ৬০-৭২ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশেষিত হওয়ার পর প্রতিদিন ৩-৪ বার মুরগির সিদ্ধ ডিমের কুসুম খাবার হিসেবে হাঁপায় সরবরাহ করা হয়। হাঁপাতে রেণু পোনাকে এভাবে ২-৩ দিন রাখার পর নার্সারি পুকুরে স্থানান্তর করা হয়।
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আশিকুর রহমান বলেন, গবেষণায় দেখা যায়- এ মাছের পুষ্টিগুণ অন্যান্য ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য মাছে ভিটামিন-এ ৬৬০ মাইক্রোগ্রাম আরএই, ক্যালসিয়াম ৮৯১ মি.গ্রাম, আয়রন ১২ দশমিক শূন্য মিলিগ্রাম এবং জিংক ৪ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, দেশে স্বাদু পানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে। এর মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় মাছের সংখ্যা ৬৪টি। দারকিনাসহ ইতোমধ্যে আরো ৩১টি দেশীয় মাছের পোনা কৃত্রিম প্রজননে উৎপাদন করা হয়েছে। বাকিগুলোও উৎপাদন করতে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা।
গবেষণা দলের প্রধান ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আউয়াল বলেন, খলিশা, বৈরালী, বাতাসি, পিয়ালিসহ দেশীয় ও বিলুপ্তপ্রায় ৩১ প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবনের নতুন সংযোজন হলো দারকিনা। এক সময় দেশের যেকোনো জলাশয় বিশেষ করে খাল-বিলের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে এ মাছটি চোখে পড়ত।
এছাড়া মাছটিকে পুকুর, স্রোতযুক্ত জলধারা ও প্লাবন ভূমিতে প্রচুর পরিমাণে দেখতে পাওয়া যেত। বর্তমানে জলাশয় সংকোচন, পানি দূষণ এবং অতি আহরণের ফলে মাছটির বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস হওয়ায় মাছটির প্রাপ্যতা সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং বর্তমানে এ মাছটি বাংলাদেশে বিপন্নের তালিকায়।
তিনি বলেন, বাজারে দারকিনা মাছ খুব একটা চোখে পড়ে না। হঠাৎ পাওয়া গেলেও ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রয় হচ্ছে। মাছটির জীনপুল সংরক্ষণের মাধ্যমে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে এর কৃত্রিম প্রজনন, নার্সারি ব্যবস্থাপনা ও চাষ কলাকৌশল উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গবেষণায় মাছটির প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা পাওয়া যায়।
এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরো বলেন, দারকিনা মাছ প্রধানত ছোট ছোট প্লাংকটন, পোকামাকড়, শেওলা এবং জলজ কীটপতঙ্গ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এ মাছের প্রজননকাল মার্চ থেকে শুরু হয়ে জুলাই মাস পর্যন্ত হলেও মে-জুলাই এদের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম।
পুরুষ মাছের তুলনায় স্ত্রী দারকিনা মাছ অপেক্ষাকৃত আকারে বড় হয়। মার্চ মাসে স্ত্রী মাছের জিএসআই ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং ডিম ধারণ ক্ষমতা ২২০০-৩২৫০ (দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ৪ সেন্টিমিটার এবং দেহ ওজন ১ দশমিক ৫-২ ধমমিক ০ গ্রাম)। প্রতি গ্রাম স্ত্রী মাছে গড়ে ৯০০-১০০০টি ডিম পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, মাছের ডিম্বাশয় মার্চ মাস থেকে পরিপক্ব হতে শুরু করে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, বিপুল পরিমাণ পোনা উৎপাদন করে আগামী এক বছরের মধ্যে দারকিনা সারাদেশে চাষাবাদের প্রচেষ্টা চলছে। চলতি বছর আরো আটটি দেশীয় মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা হাতে নেওয়া হয়েছে।
একইভাবে, গত ২-৩ বছরে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এ বছর ঢেলা, রাণী, বাতাসি, পিয়ালি, খলিশা ইত্যাদি মাছের ব্যাপক পোনা উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে এসব দেশীয় মাছের চাষাবাদে পোনা প্রাপ্তি সহজতর হবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। গবেষণার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে সব দেশীয় মাছকে খাবারের পাতে ফিরিয়ে আনা হবে।
পরিসংখ্যান মতে, ২০০৮-০৯ সালে চাষের মাধ্যমে দেশীয় মাছের উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার টন। দেশীয় মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন হওয়ায় ২০২০-২১ সালে উৎপাদন ৪ গুণ বেড়ে আড়াই লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।