logo
আপডেট : ১৯ এপ্রিল, ২০২২ ১৩:১১
লঙ্কাকাণ্ড: শঙ্কা নয়, চাই শিক্ষা ও সতর্কতা
নিজস্ব প্রতিবেদক

লঙ্কাকাণ্ড: শঙ্কা নয়, চাই শিক্ষা ও সতর্কতা

বৈদেশিক ঋণ (৫১০০ কোটি মার্কিন ডলার) শোধ করা বন্ধ করে দেউলিয়াত্ব বরণ করে নিয়েছে শ্রীলঙ্কা

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ শ্রীলঙ্কা বর্তমানে বিশ্বের কাছে এক অবাক বিস্ময়, এক চরম হতাশার নাম। বিদ্যমান দুর্দশা থেকে দেশটি মুক্তি পাবে কিনা সেটি নিশ্চিত নয়, তবে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি থেকে অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের শেখার অনেক কিছু আছে, সেটা নিশ্চিত। সার্বিক বিচারে বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার নয়। তথাপি শ্রীলঙ্কার আশঙ্কাকে একেবারেই উড়িয়ে না দিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন। দশকজুড়ে উন্নয়ন সূচক, মুদ্রাস্ফীতি, দেশজ উৎপাদন, পরিকল্পনা, বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ, আয়ের উৎস, স্থিতিশীলতা এবং মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ইত্যাদি বিবেচনায় বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার পরিণতি ঘটার সম্ভাবনা না থাকলেও শ্রীলঙ্কার পরিণতি থেকে শিক্ষাগ্রহণ ও সাবধানতা অবলম্বন নিরাপদ এবং বিচক্ষণতার পরিচায়ক।


দক্ষিণ এশীয় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য ২০১২ সালে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে গিয়েছিলাম। রাস্তা-ঘাট, সমুদ্র-উপকূল, হোটেল-রেস্তোরাঁ ইত্যাদি দেখে মনে হয়েছিল এ বুঝি দক্ষিণ এশিয়ার ইউরোপ। ছোটবেলা থেকেই জানতাম শ্রীলঙ্কার শিক্ষিতের হার প্রায় শতভাগ। কলম্বো ভ্রমণের সময় সবচেয়ে অবাক লেগেছিল রাতের বেলায় খোলা স্থানে বা রাস্তায় দামি দামি কার-পার্কিং দেখে। বাংলাদেশে তো বাড়ির বাইরে মানুষেরই নিরাপত্তা নাই, কারের কথা বাদই দিলাম। যাইহোক, সেই শ্রীলঙ্কায় চারদিকে এখন শুধু হাহাকার। অপরিকল্পিত ও অবিবেচনাপ্রসূত উন্নয়ন (অবকাঠামোগত), অসংযত ঋণ, মুদ্রাস্ফীতির উল্লম্ফন, দেশজ উৎপাদনে ধস, রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ইত্যাদি কারণে দেশটি এখন একদম পথে বসেছে বলা যায়। ইতোমধ্যে দেশটি নিজেদের ঋণখেলাপি বলে ঘোষণা দিয়েছে। বৈদেশিক ঋণ (৫১০০ কোটি মার্কিন ডলার) শোধ করা বন্ধ করে দেউলিয়াত্ব বরণ করে নিয়েছে দেশটি।


১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে শ্রীলঙ্কার জনগণ এমন দুরবস্থার মুখোমুখি হয়নি। পর্যটন, মসলা রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ তথা রেমিট্যান্স ছিল শ্রীলঙ্কার প্রধানতম আয়ের উৎস। ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কার এক প্রবীণ অধ্যাপক সঙ্গে করে শ্রীলঙ্কান বেশকিছু মসলা নিয়ে এসেছিলেন আমাদের উপহার দিতে! সবকিছু সামাল দিয়ে দেশটি এগিয়েও যাচ্ছিল। ক্রিকেটের কারণেও বিশ^ব্যাপী দেশটি বিশেষভাবে সুপরিচিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় (বিশেষত মুসলিম বিদ্বেষী) দেশটির ভিন্ন ভাবমূর্তি প্রতিভাত হয়। তথাপি দেশটির অবস্থা ভেতরে ভেতরে এতটা খারাপ হয়ে আসছিল তা ভাবনার অতীত। বোধকরি দেশটির রাজনীতিবিদ, আমলা বা পরিকল্পনাবিদগণও অনুমান করতে পারেননি।


একদিকে বৈদেশিক ঋণের বোঝা, অন্যদিকে দেশীয় উৎপাদনের সংকটের কারণে পরিস্থিতি এমন অবস্থায় ঠেকেছে যে, দেশটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছে না। জিনিসপত্রের দাম এখন আকাশছোঁয়া। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের এক ডলার সমান শ্রীলঙ্কান ৩১৫ রুপি, যা ৪ মাস আগেও ২০০ রুপির ভেতরে ছিল। বর্তমানে সেখানে চালের কেজি ৫০০ এবং এক কাপ চা বিক্রি হয় ১০০ টাকায়।
পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, কাগজের অভাবে কর্তৃপক্ষ স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। কাগজ আমদানি করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা তাদের কাছে নেই। এছাড়া জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। জ্বালানি সংগ্রহের জন্য হাজার হাজার মানুষ লাইনে ভিড় করেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সংবাদপত্রগুলো পরিস্থিতি সম্পর্কে জনগণকে প্রয়োজনীয় তথ্যও সরবরাহ করতে পারছে না, কারণ সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ নেই। জ্বালানির মতো সর্বত্র এখন খাবারের সংকট। খাবার ও জ্বালানি তেল কেনার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে সাধারণ মানুষ। যাদের হাতে অর্থ আছে তারা কিনতে পারছে না; কারণ, দোকানে খাবার নেই, জ্বালানি নেই। বিদ্যুতের অভাবে মানুষ কেরোসিনের বাতিতে ফিরছে; রান্নার জন্য নেই গ্যাস, তেলের অভাবে বন্ধ বাসের চাকা। চিকিৎসা সরঞ্জামাদি, এমনকি জীবন রক্ষাকরী ওষুধের সরবরাহ প্রায় শেষের দিকে। চারদিকে শুধু নাই নাই, আর হাহাকার। এ যেন এক অবিশ্বাস্য কাহিনি। এমন বাস্তবতা বিশ্ববাসী খুব কমই প্রত্যক্ষ করেছে।


বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট বেসামাল করে তুলেছে দ্বীপরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে। ঋণের ভারে জর্জরিত শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছে না। বৈদেশিক ঋণ ছাড়াও একদিকে দেশজ উৎপাদন হ্রাস এবং অন্যদিকে জ্বালানি তেল আমদানি করার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার অভাব দেশটিকে সর্বোতভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। ঋণের ফাঁদে (বিশেষত চায়না ঋণ) নিমজ্জিত দেশটিকে উদ্ধারের জন্য আবারো ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু তাতেও মুক্তি মিলবে বলে মনে করেন না অর্থনীতিবিদগণ ও রাজনীতি বিশ্লেষকগণ।


সাধারণভাবে যেসব কারণকে শ্রীলঙ্কার বর্তমান দুর্দশার জন্য দায়ী ভাবা হয় তার মধ্যে রয়েছে: অপরিকল্পিত প্রকল্প; ভ্যাট-ট্যাক্স হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস, দেশজ উৎপাদন হ্রাস ইত্যাদি। গত দেড় দশক ধরে শ্রীলঙ্কা ঋণনির্ভর বেশকিছু উচ্চাভিলাসী মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে অপ্রয়োজনীয় সমুদ্রবন্দর, জঙ্গলের মধ্যে বিমানবন্দর, উচ্চাভিলাসী সড়ক নির্মাণ ইত্যাদি। তাছাড়া রাজধানী কলম্বোর কাছে সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার করে আরেকটি শহর (পোর্ট সিটি) নির্মাণ করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যে প্রকল্পটি সম্পন্ন হতে ২৫ বছর সময় লাগার কথা। প্রকল্পটির জন্য বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য দেশটি বৈদেশিক বিভিন্ন উৎস থেকে মোটা সুদে ঋণ নিয়েছে। এভাবে বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হলেও, বাস্তবে দেখা গেছে অনেক প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভবান নয় এবং সার্বিক বিচারে টেকসই নয়। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ২০০৭ সাল থেকে সার্বভৌম বন্ড ইস্যু চালু করা হয়। একটি দেশের আয় অপেক্ষা ব্যয় বেশি হলে এ ধরনের সার্বভৌম বন্ড বিক্রি করা হয়। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পুঁজি বাজারে বিক্রি করে অর্থের জোগান দেওয়ার উদ্যোগ নেয় শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এই অর্থ কিভাবে পরিশোধ করা হবে সে ব্যাপারে খুব একটা চিন্তা-ভাবনা করা হয়নি।
সবমিলিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন তহবিলে শ্রীলঙ্কার ঋণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতিবছর শ্রীলঙ্কাকে বিশাল অংকের ঋণ পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চলতি বছর শ্রীলঙ্কাকে প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ চলতি বছর এসব ঋণ শোধ করতে পারবে না দেশটি। দেশীয় ঋণের পরিমাণও কম নয়। তাছাড়া সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের টান পড়েছে দেশটিতে, যে কারণে দেশটি জ্বালানি তেল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছে না। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ভ্যাট ও ট্যাক্স কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। হঠাৎ এ ধরনের পদক্ষেপে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। ভ্যাট-ট্যাক্স কমানোর মূল কারণ ছিল অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করা। ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধোত্তর শ্রীলঙ্কায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে (বর্তমান প্রেসিডেন্টের ভাই) এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর ফলে তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিতে গতি এসেছিল। সেই বাস্তবতার আলোকে, অথচ বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসেও একই পদক্ষেপ নেন; কিন্তু এর কয়েক মাসের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সরকারের রাজস্ব আয় প্রায় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার আরো ঋণ নিতে বাধ্য হয়। করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় দুই বছর পর্যটন শিল্পে কর্মকা- বন্ধ থাকায় চরম সংকটে পড়েছে দেশটি। করোনাভাইরাস উদ্ভূত বিধিনিষেধের কারণে দেশটির পর্যটন খাতে বিপর্যয় নেমে আসে। উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কায় সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসত থেকে চীন থেকে।


শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেকটি বড় ক্ষেত্র হচ্ছে বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের পাঠানোর অর্থ তথা রেমিট্যান্স। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগে যেখানে শ্রীলঙ্কা বছরে ৭-৮ বিলিয়ন ডলার (জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ) রেমিট্যান্স পেত; তা ২০২১ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ৫.৪৯ বিলিয়নে (গত দশ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন)।
দেশজ উৎপাদন ও অর্গানিক বিপর্যয় বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয়। ২০১৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে হঠাৎ করে, কোনোপ্রকার আলাপ-আলোচনা না করেই অর্গানিক কৃষি চালু করেন। কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল স্থানীয় কৃষি অর্থনীতিতে। ফলে চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। একসময় চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্রীলঙ্কা বাধ্য হয় ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করতে। অর্গানিক কৃষি চালু করার আগে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা বা বৈজ্ঞানিক মহলে পরামর্শ নেয়া হয়নি। পরিণতিতে ফল হয়েছে উল্টো। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন কমে যাওয়ায় গ্রামের কৃষকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে খাদ্য আমদানি করার জন্য আরো বৈদেশিক মুদ্রার খরচ করতে হয়েছে দেশটিকে। চায়ের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রসিদ্ধ দেশটি চা রপ্তানিতেও বিপর্যয় নেমে আসে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সাহায্য ও পুনরায় ঋণের জন্য দেশটি অনেকের দ্বারস্থ হচ্ছে। তবে কোনো দেশ শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিতে ভরসা পাচ্ছে না। কারণ অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় শ্রীলঙ্কাকে অনেকটা একা এই পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে।
শ্রীলঙ্কা শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন চিনেছে, টেকসই উন্নয়ন বুঝেনি। টেকসই উন্নয়ন তথা পরিবেশগত ভারসাম্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সামাজিক অগ্রগতির ভারসাম্য বজায় রেখে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করলে শ্রীলঙ্কাকে এই পরিণতি ভোগ করতে হতো না। শ্রীলঙ্কার এই বিপর্যয় শ্রীলঙ্কা ও অপরাপর উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য শিক্ষা। শ্রীলঙ্কার যখন এই পরিস্থিতি, ঠিক কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশ অনেকটি মেগাপ্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে। সবটির প্রয়োজনীয়তা বা প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ (যেমন রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, কিংবা উড়াল সেতু)।


বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি বৈদেশিক মুদ্রা ও পোশাক শিল্প। দুটিই বিদেশনির্ভর। তাছাড়াও মেগা প্রজেক্টগুলোর অধিকাংশ অর্থই বৈদেশিক ঋণনির্ভর। বছরের পর বছর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ দুটি খাতের সুনীল বাতায়ন প্রবাহিত থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশে পোশাকশিল্পে যেমন আজ উত্থান বিদ্যমান, তেমনি ধসও সময়ের ব্যাপার। বিদেশি কোম্পানিগুলো ভালো সুযোগ পেলে অন্য কোনো দেশমুখী হয়ে যেতে কতক্ষণ? বিশেষ করে অন্যত্র নিরাপত্তা, কম পারিশ্রমিক ও স্থিতিশীলতা দেখলে তারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়েও নিতে পারে। অন্যদিকে পোশাকশিল্পে কর্মীদের যে পরিবেশে কাজ করতে হয় এবং ন্যূনতম বেতন নিয়েও তাদের প্রতিনিয়ত যেভাবে জীবনসংগ্রাম করতে হয়, দ্রুত পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় বিকল্প কোনো নিরাপদ সুযোগ পেলে তাদেরও পোশাকশিল্প ত্যাগ করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, চাহিদা, স্থিতিশীলতা, বৈশ্বিক দুর্যোগ ইত্যাদি অনেক কারণে রেমিট্যান্সের খাতেও বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তাছাড়া চলমান ডিজিটাল ও গোলোকায়ন যুগে আর কয়েক বছর পর বাংলাদেশ থেকে অদক্ষ ও অশিক্ষিত শ্রমিকের আন্তর্জাতিক প্রয়োজনীয়তা অনেকটা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের অগ্রগতিকে শ্লথ করতে, ঋণ নির্ভরতা এবং ঋণের অপচয়ের জন্য গণহারে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠন ও অর্থ লোপাট একটা সম্ভাব্য কারণ। এর প্রতিকারের কার্যকর ব্যবস্থাও দৃশ্যমান নয়। পরিবর্তন বা বিপর্যয়ের এই সম্ভাবনাগুলো বিবেচনায় নিয়ে স্থিতিশীল ভবিষ্যতের লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে গণমুখী উৎপাদন, বিশেষ করে গ্রামীণ উন্নয়নের দিকে সুনজর প্রদান আবশ্যক। জনমিতিক লভ্যাংশ (population dividend) বা কর্মক্ষম তরুণদের নিয়ে কার্যকর পরিকল্পনা হতে পারে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের অগ্রগতির অন্যতম হাতিয়ার, যা এখন অব্দি সুপরিকল্পিত ও আশানুরূপ নয়।


সরকারি বেসরকারি অর্থনীতি ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অধিকাংশের দাবি অনুযায়ী শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতির সম্ভাবনা নেই বাংলাদেশের। এর অন্যতম একটি কারণ বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটা নিরাপদ। যেখানে শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু ঋণ ১৬৫০ ডলার, সেখানে বাংলাদেশের মাথপিছু ঋণের পরিমাণ ২৯২.১১ ডলার; অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু ঋণ বাংলাদেশের চেয়ে পাঁচ গুণেরও বেশি। তবে ঋণই সবকিছু নয়, অর্থনীতির অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশকে বিদ্যমান স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হবে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক ঋণ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি শ্রীলঙ্কার অনুরূপ নয়; সুতরাং বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। তথাপি শ্রীলঙ্কার দুর্বলতা থেকে শিক্ষা নিতে দোষ নেই। আত্মতুষ্টিতে নিমজ্জিত না থেকে, শ্রীলঙ্কার পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে অর্থনীতির অনেক ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশেকে যেন কোনোক্রমেই শ্রীলঙ্কার ভাগ্য বরণ করতে না হয়, সেজন্য আগে থেকেই সচেতন ও সতর্ক হওয়া অত্যাবশ্যক।


লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়