বয়স মাত্র চল্লিশের ঘরে। এরই মধ্যে ব্রেইনে বাসা বাঁধল মরণঘাতী ক্যানসার। যার সঙ্গে লড়াই চলল বেশ কিছুদিন। তার পাশে এসে দাঁড়ালেন ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সবাই। তারপরও জয় করা গেল না সব। না ফেরার দেশে চলে গেলেন ক্রিকেটার মোশাররফ হোসেন রুবেল। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে জানাজা শেষে মোশাররফ হোসেন রুবেল চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বনানী কবরস্থানে। তার বিদায়ে শোকাচ্ছন দেশের ক্রিকেটাঙ্গন।
সাধারণত খেলা না থাকলে শেরেবাংলার ফ্লাড লাইট জ্বলে না। মঙ্গলবার রাতে জ্বলল রুবেলের জানাজার জন্য। প্রয়াত ক্রিকেটারকে বিদায় জানাতে ছুটে এসেছিলেন সাবেক-বর্তমান ক্রিকেটার ও কোচরা। রুবেলের ভক্ত, স্বজন, সংগঠকেরাও। এ সময় শোকের চিহ্ন ফুটে উঠে মাশরাফি-মুশফিকদের চোখেমুখে। তাদের কাঁধে চড়েই শেষবারের মতো শেরেবাংলায় আসেন রুবেল।
ক্রিকেটারদের পাশাপাশি আম্পায়ার, বিসিবি পরিচালক, স্টেডিয়ামে কর্মরত কর্মী, পৃষ্ঠপোষক, প্রিমিয়ার ব্যাংকের কর্মকর্তারাও ছুটে আসেন রুবেলকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। সাইরেন বাজিয়ে যেমন স্টেডিয়ামে ঢুকেছে লাশবাহী গাড়ি; তেমনি সাইরেন বাজিয়েই প্রস্থান হয় রুবেলকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি। মাঝের সময়টায় মিরপুরের বাতাস ভারি হয়ে উঠল।
জানাজা শেষে রাতেই রুবেলকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় বনানী কবরস্থানে। রুবেলের দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর মাতমটা যেন বেড়ে গেল কয়েকগুণ। জানাজা শেষে রুবেলের স্মৃতিচারণ করে জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ও বিসিবি পরিচালক আকরাম খান বলেন, ‘একটা ভালো মানুষের যেসব গুণ থাকা দরকার, রুবেলের সব ছিল। উদাহরণ দেওয়ার মতো একজন মানুষকে আজ (মঙ্গলবার) আমরা হারালাম।’
রুবেলকে শেষবার মাঠে দেখা গিয়েছিল ২০১৯ সালে। বিপিএলের ওই মৌসুমে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের হয়ে খেলেন তিনি। জাতীয় দলের হয়ে তার শেষ ম্যাচটাও ছিল এই মিরপুরেই; ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ৪০ বছর বয়সি রুবেল বাংলাদেশ দলের হয়ে পাঁচটি ওয়ানডেতে ৪ উইকেট নিয়েছেন। এ ছাড়া ব্যাট হাতে করেন ২৬ রান। ঘরোয়া ক্রিকেটে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২৭২টি ম্যাচে ৫৫০টির বেশি উইকেট নিয়েছেন বাঁ-হাতি এই স্পিনার।
রুবেলের বাঁচার যুদ্ধ শুরু হয় ২০১৯ সালের মার্চে। ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে তার। লম্বা সময় ধরে লড়াই করছিলেন তিনি। অস্ত্রোপচার করানোর পর প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। গত জানুয়ারিতে পুরোনো ব্যাধিতে নতুন করে আক্রান্ত হন রুবেল। পুনরায় শুরু হয় কেমোথেরাপি। গত মাসের মাঝামাঝিতে তাকে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে।
নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) পর্যন্ত নেওয়া হয় রুবেলকে। পরে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। তার পাশে দাঁড়িয়েছিল দেশের ক্রিকেটের প্রায় সব মহল। চিকিৎসার ব্যয় তাতে কিছুটা হলেও সংকুলান হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়। শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে গেলেন রুবেল।
ক্যানসারের সঙ্গে মোশাররফের লড়াইয়ে আর্থিক-মানসিক ও নানাভাবে পাশে থেকেছেন বর্তমান-সাবেক ক্রিকেটারদের অনেকেই। গত মাসেই সাকিব আল হাসানের প্রতিষ্ঠান মোনার্ক মার্ট থেকে ১৫ লাখ টাকা দেওয়া হয় মোশাররফের চিকিৎসার সহায়তায়। সাবেক স্পিনার তখনো ছিলেন হাসপাতালে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বুধবার সকালে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে সাকিব বলেন, পথেই তিনি খবরটা পেয়েছেন আর জীবনের কঠিন সত্যটিও উপলব্ধি করেছেন আরেকবার। তিনি বলেন, ‘আসলে খুবই দুঃখজনক। আমি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম, নিউজ দেখছিলাম যে উনি মাত্র বাসায় গেলেন, একটু ভালো অনুভব করছিলেন। ভাবলাম যে কোনোভাবে বুঝি সারভাইভ করলেন। আরেকজনের সঙ্গে কথাও বলছিলাম এটা নিয়ে যে, হয়তো কম বয়স দেখে সারভাইভ করতে পারছেন। তবে হঠাৎ করে খবরটা পাই যখন প্লেনে ছিলাম। খুবই দুঃখজনক। তবে জীবনে যে কোনো কিছুর গ্যারান্টি নেই, সেটির একটি প্রমাণ।’
মিরপুর শেরবাংলা স্টেডিয়ামে মোশাররফের জানাজা নামাজে ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। মোশাররফের স্ত্রী ফারহানা রূপা নানা সময়েই বলেছেন, ক্যানসারের সঙ্গে তাদের এই লড়াইয়ে শুরু থেকেই নানাভাবে তারা পাশে পেয়েছেন মাশরাফিকে। বন্ধুর বিদায়ে বাংলাদেশের সফলতম ওয়ানডে অধিনায়ক ফেসবুকে একটি ছবি দিয়ে শুধু লিখেছেন, ‘ভালো থাকিস বন্ধু।’
ফেসবুকে শোক জানিয়ে মোশাররফ রুবেলের জন্য দোয়া চান মুশফিকুর রহিম, ‘মোশাররফ রুবেল ভাইয়ের খবরটি জেনে সত্যিই খারাপ লাগছে। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি, পরিবারের সদস্যদের জন্যও প্রার্থনা থাকছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য দিনটি দুঃখের। চলুন আমরা সবাই তার জন্য দোয়া করি।’
এছাড়াও তার বিদায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক প্রকাশ করেন তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ, মুমিনুল হক, মুস্তাফিজুর রহমান, সৌম্য সরকার, মেহেদী হাসান মিরাজসহ বর্তমান-সাবেক ক্রিকেটারদের অনেকে।