২০তম রোজার দোয়া- হে আল্লাহ! এ দিনে আমাদের জন্য বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দিন এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দিন। আমাদের কোরআন তিলাওয়াতের তাওফিক দান করুন; হে ঈমানদারদের অন্তরে প্রশান্তি দানকারী।
আজ ২০ রমজান। মাগফিরাতের ১০ দিন শেষ হয়ে আগামীকাল থেকে নাজাতের ১০ দিন শুরু হবে। একইসঙ্গে ইতিকাফও শুরু করবেন অনেকে। করোনার মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইতিকাফ করবেন অনেকে। তাই ইতিকাফের ফজিলত ও গুরুত্ব নিয়ে আমরা আলোচনা করব। ইতিকাফ শব্দের অর্থ হচ্ছে স্থির থাকা, আবদ্ধ থাকা, অবস্থান করা। শরিয়াতের পরিভাষায় মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন বা যেকোনোদিন দুনিয়াবি সব কাজ-কর্ম তথা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মসজিদে বা ঘরের পবিত্র স্থানে ইতিকাফের নিয়তে থাকাকে ইতিকাফ বলে। ২০ রমজান সূর্যাস্তের প্রাক্কাল থেকে মসজিদে ইতিকাফ শুরু করতে হবে এবং ২৯ বা ৩০ রমজান চাঁদ দেখার পরে ইতিকাফকারীদের মসজিদ থেকে বের হতে হবে।
রমজানের শেষ ১০ দিন মসজিদে ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির লাভের জন্য যেসব ইবাদত করা হয়, তার মধ্যে ইতিকাফ একটি অন্যতম ইবাদত। আত্মার উৎকর্ষ সাধনের জন্য সব ধরনের কুপ্রবৃত্তি দমন করে যেমন অনর্থক কাজ, অশ্লীল কথাবার্তা, সংসার, স্ত্রী, পুত্র, বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সব ধরনের দুনিয়াদারির কাজকর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তার দরবারে দিনরাত্রি পড়ে থাকাই ইতিকাফের মূল লক্ষ্য।
হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করবে সে দুটি ওমরাহ ও দুটি হজ আদায় করার সওয়াব পাবে।’ হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত, ‘নবী করিম (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ পালন করতেন। তার ওফাতের আগ পর্যন্ত তিনি ইতেকাফ পালন করে গেছেন। তারপর তার স্ত্রীরাও তা পালন করেছেন।’ হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ইতিকাফকারী নিজেকে পাপ থেকে মুক্ত রাখে এবং তার জন্য পুণ্যগুলো জারি রাখা হয়। (মেশকাত)। ইতিকাফের সময় বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করার পাশাপাশি নফল নামাজ, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার, দোয়া-দরূদ, দান-সদকা ইত্যাদি নফল আমলের প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত।
ইতিকাফের জন্য কিছু শর্ত রয়েছে- ১. পুরুষ লোক মসজিদে ইতিকাফ করবেন; ২. ইতিকাফের নিয়ত করতে হবে; ৩. সর্বদা পাক-পবিত্র থাকতে হবে; ৪. ইতিকাফকারী রোজাদার হবে; ৫. মহিলারা পর্দা করে ঘরে ইতিকাফে থাকতে পারবেন।
ইতিকাফের অনেক গুরুত্ব রয়েছে, যা রাসূলের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। ইতিকাফ করা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি সুন্নত আমল। ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদ থেকে বের হওয়ার বিধান রয়েছে। ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদ থেকে বের হওয়া তিন ধরনের হতে পারে- ক. মানবীয় প্রয়োজনে বের হওয়ার অনুমতি রয়েছে। যেমন পায়খানা, প্রস্রাবের জন্য, খাওয়া-দাওয়ার জন্য, পবিত্রতা অর্জনের জন্য। তবে শর্ত হলো এসব বিষয় যদি মসজিদের গণ্ডির মাঝে সেরে নেওয়া যায়, তবে মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না; খ. এমন সব নেক আমল বা ইবাদত-বন্দেগির জন্য বের হওয়া যাবে না, যা তার জন্য অপরিহার্য নয়। যেমন রোগীর সেবা করা, জানাজায় অংশ নেওয়া ইত্যাদি এবং গ. এমন সব কাজের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না, যা ইতিকাফের বিরোধী। যেমন ক্রয়-বিক্রয়, চাষাবাদ ইত্যাদি। ইতিকাফ অবস্থায় এসব কাজের জন্য মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ বাতিল হয়ে যায়।
ইতিকাফবাসীর দোয়া আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন। রমজানের শেষ ১০ দিনের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এ শেষ ১০ দিনে মসজিদে ইতিকাফ করতেন। প্রয়োজন ব্যতীত তিনি মসজিদ থেকে বের হতেন না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, ‘নবী করিম (সা.) প্রতি রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিফাক করতেন। তারপর যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর ২০ দিন ইতিফাক করেন।’ (বুখারি)।
ইতিকাফের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এক দিনের ইতিকাফ করল, আল্লাহ পাক তার ও দোজখের মধ্যখানে এমন তিনটি পরিখা তৈরি করে দেবেন, যার একটি থেকে অপরটির দূরত্ব হবে পূর্ব ও পশ্চিমেরও বেশি।’ (তিরমিজি ও বায়হাকি)। যে ব্যক্তি ইবাদত মনে করে সওয়াবের নিয়তে ইতেকাফ করে, তার সব সগিরা গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। নবী করিম (সা.) ফরমান, ‘ইতিকাফকারী ব্যক্তি যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত থাকে আর ইতিকাফে লিপ্ত থাকার জন্য কোনো ব্যক্তি বাইরের কোনো নেক কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকলেও ওই নেক কাজগুলোর পূর্ণ নেকি সে লাভ করবে।’ (ইবনে মাজা)।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘ইতিকাফকারী মূলত গুনাহ থেকে দূরে থাকে এবং তাকে ইতিকাফের বিনিময়ে এত বেশি নেকি দেওয়া হবে, যেন সেসব নেকি অর্জনকারী।’ (ইবনে মাজা)। ইতিকাফের সর্বনিম্ন সময়সীমা এক রাত বলে হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে। তবে ইতিকাফ দীর্ঘসময় ধরে করা উত্তম, বিশেষত মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ অবস্থায় থাকায় লাইলাতুল কদর বা হাজার মাসের শ্রেষ্ঠতম ভাগ্যের রজনী লাভের সৌভাগ্য হতে পারে। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে পবিত্র মাহে রমজানে ইতিকাফ করার মাধ্যমে গুনাহ থেকে বেঁচে থেকে অশেষ নেকি লাভের তাওফিক এনায়েত করুন! আমিন।
লেখক: উপ-পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়। [email protected]