অপর্যাপ্ত সচিত্র সতর্কবার্তার কারণে তামাকদ্রব্যে ঝুঁকছেন দেশের তরুণরা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। পাশের দেশ ইন্ডিয়ায় তামাকপণ্যের প্যাকেটে ৮৫ শতাংশ জায়গা জুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণ করা হয়। নেপালে এটি ৯০ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে তা এখনো মাত্র ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে। প্যাকেটে বা মোড়কের ওপরের দিকে ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে মুদ্রণ করার কথা থাকলেও মুদ্রণ করা হচ্ছে প্যাকেটের নিচের অংশে। দক্ষিণ এশিয়ায় তামাকের সচিত্র সতর্কবার্তায় পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
তামাকে নিরুৎসাহিত করতে প্যাকেটের ৯০ শতাংশ জায়গাজুড়ে সচিত্র সতর্কবার্তা দেওয়াসহ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে ছয়টি সংশোধনী আনার প্রস্তাব দিয়েছে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো। শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে আন্তরিক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও।
প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এফসিটিসির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
জানা গেছে, এই ছয়টি প্রস্তাব নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দুই দফায় বৈঠকও করেছেন সংশ্লিষ্টরা। একটি ড্রাফও তৈরি করা হয়েছে। ঈদের পর এ বিষয়ে অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর মতামত চাওয়া হতে পারে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অধিশাখা) ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল সংশোধনী আনয়নে গঠিত কমিটির সমন্বয়কারী হোসেন আলী খোন্দকার বলেন, তামাকবিরোধী সংগঠন যে ছয়টি সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়েছে সেগুলো নিয়ে কাজ চলছে।
তামাক মৃত্যু ঘটায়। বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার উদ্বেগজনক। বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ (জিএটিএস, ২০১৭) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ২ কোটি ২০ লক্ষ (২০.৬ শতাংশ) এবং ধূমপায়ী ১ কোটি ৯২ লক্ষ (১৮ শতাংশ)।
বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯.২ শতাংশ (জিএসএইচএস, ২০১৪), যা উদ্বেগজনক। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ অকালে মৃত্যু বরণ করে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। তামাক ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন জটিল অসংক্রামক রোগ যেমন, হৃদরোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ধূমপানের কারণে নারী পুরুষের ক্যান্সার হয়। তামাক গ্রহণ স্নায়ুতন্ত্র প্রভাবিত করে, যার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। ক্ষুধামন্দা হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। ধূমপানের সময় যে ধোঁয়া বাইরে বের হয়, তা বাতাসে মিশে দূষণ তৈরি করে। এই দূষিত বায়ু চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে নারী-শিশু-বয়স্কদের ক্ষতি করে। ধূমপায়ীদের ক্যান্সারের ঝুঁকি সাধারণ মানুষের চেয়ে ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি। ধূমপানের কারণে হৃদরোগ হয়। স্ট্রোক, কিডনি সমস্যা উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি বেড়ে যায়। স্বাভাবিক জীবন যাত্রা ব্যাহত হয়। মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। ধূমপানের কারণে নারী পুরুষ উভয়ের সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা লোপ পায়। তাই তামাক গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। তামাক গ্রহণে মানুষকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকরভাবে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার বাস্তবায়ন তামাক নিরুৎসাহিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বড় আকারের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা নতুনদের মধ্যে তামাক ব্যবহার শুরু থেকে নিরুৎসাহিত করে এবং বর্তমান ব্যবহারকারীদের তামাক ছাড়তে উৎসাহিত করে। বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা চালু থাকলেও তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণে তা যথেষ্ট কার্যকরী নয়।
তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটার আকার/আয়তন কেমন হবে এবং এর মধ্যে ন্যূনতম কি পরিমাণ তামাকজাত দ্রব্য/শলাকা থাকবে তা বর্তমান আইনে উল্লেখ নেই।
ফলে বাজারে তামাকপণ্যের ধরন (সিগারেট, বিড়ি, জর্দা ও গুল) ভেদে বিভিন্ন আকার (আয়তকার, গোলাকার) ও আয়তন (৮/১০ শলাকা, ৫-১০০ গ্রাম গুল-জর্দা) এর প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন/কৌটার প্রচলন রয়েছে এবং তামাকপণ্যের প্যাকেটে যথাযথভাবে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণ সম্ভব হচ্ছে না।
অন্যদিকে আইনের ১০ নং ধারা অনুযায়ী তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ওপরের ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণ বাধ্যতামূলক হলেও তা নিচের ৫০ শতাংশে মুদ্রণ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- যা অপেক্ষাকৃত কম কার্যকরী।
তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর দেওয়া ছয়টি সংশোধনী প্রস্তাবের মধ্যে একটি হচ্ছে সচিত্র সতর্কবার্তার আকার বড় করা। তারা প্রস্তাব করেছেন- সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করতে হবে এবং সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটার আকার/আয়তন এবং এগুলোর মধ্যে ন্যূনতম কী পরিমাণ তামাকজাত দ্রব্য থাকবে তা নির্ধারণ করে দিতে হবে।
বড় আকারের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা সহজেই তরুণ ও ব্যবহারকারীদের তামাকের ব্যবহার ছাড়তে উৎসাহিত করে। উরুগুয়ে ও অস্ট্রেলিয়ায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, সচিত্র সতর্কবার্তার আকার বাড়ানো হলে ব্যবহারকারী স্বাস্থ্যক্ষতির বিষয়ে ভাবতে বাধ্য হয় এবং তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয়।
মেক্সিকোতে এক গবেষণায় দেখা গেছে, বৃহদাকার সচিত্র সতর্কবার্তা অল্প বয়সীদের (১২-১৪ বছর) মধ্যে সিগারেটের প্রতি আকর্ষণ কমায়। তামাক কোম্পানি নির্ধারিত/নির্দিষ্ট আকারের মোড়কে তামাকপণ্য বাজারজাতকরণে বাধ্য হলে মোড়কে মুদ্রিত সচিত্র সতর্কবার্তার কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
বিশ্বের ৮৩টি দেশ তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ৫০ শতাংশের অধিক জায়গা জুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ করছে। যার মধ্যে নেপাল, মালদ্বীপ ৯০ শতাংশ, ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ড ৮৫ শতাংশ, শ্রীলংকা ৮০ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়া ৮২.৫ শতাংশ, উরুগুয়ে ৮০ শতাংশ ও তুরস্ক ৯২.৫ শতাংশ।
অন্যদিকে, বিশ্বের ১৮টি দেশে প্লেইন প্যাকেজিং প্রথা বাস্তবায়ন করছে, যার মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া ২০১২ সালে, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ২০১৭ সালে, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ২০১৮ সালে, হাঙ্গেরি, সৌদি আরব, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, কানাডা, উরুগুয়ে ২০১৯ সালে, স্লোভেনিয়া, ইসরায়েল, সিঙ্গাপুর ২০২০ সালে, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এবং ডেনমার্ক ২০২১ সালে।
এ ছাড়া আরো ২০টি দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কা, জর্জিয়া, মরিশাস, সাউথ আফ্রিকা, রোমানিয়া, তাইওয়ান, ব্রাজিল, চিলি, গুয়েরন্সে, জার্সি, ইকুয়েডর, পানামা, জাম্বিয়া, বোতসোয়ানা, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, ইউনাইটেড আরব আমিরাত (ইউএই), ফিনল্যান্ড ও সুইডেন প্লেইন প্যাকেজিং প্রবর্তনের পথে উল্লেখযোগ্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।