logo
আপডেট : ২২ এপ্রিল, ২০২২ ১০:৫৫
আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বজ্রপাত
* আগামী জুন পর্যন্ত চলতে পারে বজ্রপাতের তাণ্ডব * জলবায়ু পরিবর্তন ও বায়ুদূষণের কারণে বজ্রপাত বিধ্বংসী রূপ নিচ্ছে * উত্তর-পশ্চিম কোণে কালো মেঘ জমলেই নিরাপদে সরে যাওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
শাহীন রহমান

আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বজ্রপাত

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতের আগাম সঙ্কেত ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা গেলে উদ্বেগজনক প্রাণহানির হার কমিয়ে আনা সম্ভব।

বৈশাখ শুরু না হতেই আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে বজ্রপাত। সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর ঘটনাও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কালবৈশাখী ঝড় এবং বজ্রপাত দেশে নতুন নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সম্প্রতি বজ্রপাতের হার বেড়েছে বহু গুণে। বিধ্বংসী রূপ নেয়ার কারণে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ছে। সচেতন হওয়া ছাড়া বজ্রপাতের হাত থেকে মৃত্যু এড়ানোর পথ নেই। প্রতি বছর মার্চের শেষ ভাগ থেকে জুনের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বজ্রপাতের আশঙ্কা বেশি দেখা দিচ্ছে।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, এ বছর শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই আবহাওয়া অস্বাভাবিক আচরণ করছে। আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, আবহাওয়া বৈশিষ্ট্যের ধরন অনুযায়ী দেশে মার্চে শেষ হতে বজ্রপাতের আশঙ্কা বেড়ে যায়। সম্প্রতি বছরগুলোতে বজ্রপাত মারাত্মক রূপ ধারণ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণেই বজ্রপাতের মাত্রা বাড়ছে। সেই সঙ্গে মানুষের মৃত্যু ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বৈশাখ মাসে আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণে মেঘের আনাগোন দেখা দিলে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে হবে। কারণ এই ধরনের মেঘে কালবৈশাখী ঝড় ও বজ্রপাতের সম্ভবনা বেশি থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে দেশে এই দুর্যোগের মাত্রা এত সাংঘাতিক ছিল না। ফলে বন্যা-জলোচ্ছ্বাসকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলা হলেও বজ্রপাতকে কখনো এই তালিকায় আনা হয়নি। সাম্প্রতিককালে এর মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ২০১৬ সালের বজ্রপাতকে প্রথমবারের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় নিয়ে আসা হয়েছে।

বজ্রপাত যেহেতু সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য একটি দুর্যোগ, এর হাত থেকে রক্ষা পেতে ব্যাপকভাবে জনগণকে সচেতন করে তোলার বিকল্প নেই। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে দেশে প্রতিবছর গড়ে দুইশ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বজ্রপাতে। এ হার বিশ্বের দ্বিতীয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপকরা বলছেন, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত উগান্ডায় হলেও জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে বাংলাদেশে এ ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। আকাশে ‘কিউমুলো নিমবাস’ (ঘন কালো মেঘ) টাইপের মেঘ দেখা দিলে বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়া যেতে পারে। এই মেঘ দেখতে সুন্দর হলেও এর আড়ালেই বিপদ লুকিয়ে থাকে। এই মেঘ মাটির দুই কিলোমিটার ওপর থেকে ওপরে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্তর আকারে থাকে। বজ্রপাতের পাশাপাশি এ মেঘ থেকেও শিলাবৃষ্টি হয়। এই মেঘ তৈরির সময় বাইরে অবস্থানকালে যদি দেহের ও মাথার লোম খাড়া হয়ে যায় তাহলে ভাবতে হবে বজ্রপাতের ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। কারণ সেখানে এক ধরনের ইলেক্ট্রনিক চার্জ তৈরির কারণে এটি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের বজ্রপাতে মৃত্যুর ৪০ ভাগ মে মাসে ঘটছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বে বজ্রপাতে মৃত্যুর এক চতুর্থাংশ ঘটছে বাংলাদেশে।

সম্প্রতি নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত দেশের সুনামগঞ্জে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতে আঘাত হানছে। দেশের পূর্বাঞ্চলে বেশি বজ্রপাতের কারণ হিসেবে তারা ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকে দায়ী করেছেন।

এতে বলা হয়েছে, ভারতের খাসি পাহাড় ও মেঘালয় এলাকায় মে মাস পর্যন্ত ঘন ঘন মেঘ জমে। স্তরীভূত মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সুনামগঞ্জে বজ্রপাতের পরিমাণ বেশি। প্রতি বছর মার্চ থেকে মে মাসের শেষ দিকে বোরো ধান কাটতে হাওরে বেশিসংখ্যক মানুষ থাকায় হতাহতের ঘটনা বেশি হচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, বজ্রপাতের ৯৪ ভাগ গ্রামীণ জনপদে। এর মধ্যে উন্মুক্ত স্থানে ৮৬ ভাগ মানুষ মারা যাচ্ছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতের আগাম সঙ্কেত ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা গেলে উদ্বেগজনক প্রাণহানির হার কমিয়ে আনা সম্ভব। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিদিন সকালে আবহাওয়ার বার্তা পর্যবেক্ষণ করা, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থাকলে ঘন ঘন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পূর্বপ্রস্তুতি সম্পর্কে শ্রমিকদের অবহিত করার ব্যবস্থা করা দরকার। আর কর্মস্থলের নিকটবর্তী নিরাপদ স্থান চিহ্নিত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা অপরিহার্য।

তবে বজ্রপাতের সঠিক কারণ জানা না গেলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময়ে কালবৈশাখী এবং বজ্রপাতের জন্য যে মেঘ সবচেয়ে বেশি দায়ী তা হলো ‘কিউমুলো নিমবাস মেঘ। চৈত্র বৈশাখ মাসে এই মেঘ থেকেই সাধারণত কালবৈশাখী ও বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। এই সময় উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশে হঠাৎ এই ধরনের মেঘ জমে মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে যায়। এই সময় আকাশে এই ধরনের মেঘ জমলে কালবৈশাখী ও বজ্রপাতের আশঙ্কা শতভাগ বেড়ে যায়। এ কারণে এই মেঘ জমার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেলে বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।

আবহাওয়াবিদদের মতে বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে গ্রীষ্মকাল সময়টাতে বজ্রপাতের মাত্রা অনেক বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু সম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বজ্রপাত বিধ্বংসী রূপ নিয়েছে। ঋতু বৈচিত্র্যের ধরন অনুযায়ী চৈত্র-বৈশাখ মাসে এ দেশে সবচেয়ে বেশি কালবৈশাখী এবং বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে থাকে। এ বছর মধ্য চৈত্র থেকে কালবৈশাখী শুরু হয়েছে। এখনও দেশের বিভিন্ন জায়গায় কালবৈশাখী অব্যাহত রয়েছে। কালবৈশাখী ঝড় এবং বজ্রপাত উভয় কারণে প্রায় প্রতিদিন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।