logo
আপডেট : ২২ এপ্রিল, ২০২২ ১২:৫১
নাসিরনগরে ৩৫০ হেক্টর জমি পানির নিচে
‘এক মুঠো ধানও হাওর থেকে বাড়িতে আনতে পারি নাই’
জুয়েল রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

‘এক মুঠো ধানও হাওর থেকে বাড়িতে আনতে পারি নাই’

মেদির হাওরে আধাপাকা ধান কাটছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক বিজয় ঋষি

‘হাওরে আট কানি জমি আছে। এ বছর ইরি, বোরো ধান লাগাইছিলাম। ধানও আইছিল ভালো। কিন্তু আগাম বানের পানি সব তলাইয়া নিয়া গেছে। এক মুঠো ধানও হাওর থেকে বাড়িতে আনতে পারি নাই। শুষ্ক মৌসুমে এ ধানের জমি ছিল একমাত্র অবলম্বন। আর বর্ষা মৌসুমের মাছ বিক্রি করে চলত আমার পরিবারের জীবনযাত্রা। কিন্তু এ বছর ফসল হারিয়ে আমি নিঃস্ব।’

কথাগুলো বলছিলেন হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক নাসিরনগর উপজেলার পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা রূপন দাস। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার মেদির হাওর, আকাশি হাওর, বালিয়া বিল ও আটাউরি বিলের বিস্তীর্ণ ফসলি জমির মাঠ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। গত দু’দিনের ঝড়-বৃষ্টিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়েছে। এতে করে কয়েক হাজার কৃষক বছরের একমাত্র ফসল হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন।

যদিও উপজেলা প্রশাসন এবং কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাদেরকে বিশেষ প্রণোদনার আওতায় আনা হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৫০ হেক্টর জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তবে হাওর অঞ্চলের কৃষকদের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। গত দু’দিনের ব্যবধানে ঝড়-বৃষ্টিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়েছে বলে দাবি কৃষকদের।

হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক নাসিরনগর সদর উপজেলার কামারগাঁও এলাকার বাসিন্দা বিজয় ঋষি। তিনি রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় একটি ব্যাংকের সামনে জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন। অভাব-অনটনে পরিবার নিয়ে চলছিলেন অনেকটাই কষ্টের মধ্যে।

পরিবার নিয় একটু স্বাচ্ছন্দ্যে চলার আশায় এ বছর অন্যের কাছ থেকে ১৫ কানি জমি বর্গা নিয়ে বোরো এবং বিআর-২৮ ধানের আবাদ করেছিলেন তিনি। কিন্তু বিধিবাম, উজান থেকে নেমে আসা আগাম বানের পানিতে তলিয়ে গেছে তার স্বপ্নের সোনালি ফসল। আধাপাকা ধানগুলো পানির নিচে দেখে অনেকটাই নির্বাক হয়ে পড়েছেন তিনি।

মেদির হাওরে আধাপাকা ধান কাটার সময় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বাকরুদ্ধ কৃষক বিজয় ঋষি হঠাৎ কেঁদে উঠেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এ বছর ১৫ হাজার টাকা দিয়ে গ্রামের খোকা ঋষি এবং সন্ন্যাসী ঋষির কাছ থেকে ১৫ কানি জমি বর্গা নিয়েছিলাম। আশা ছিল, ফসল পেলে কিছু বিক্রি করে ধারদেনা, ঋণ পরিশোধ করব। কিছু ধান চাল করে নিজেদের খাবারের জন্য রাখব। এখন সব আশা ফিঁকে হয়ে আসছে।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বেঁচে থাকার জন্য একমাত্র অবলম্বন ছিল এই ধানের জমি। স্বপ্নের সোনালি ফসল এভাবে চোখের সামনে পানির নিচে চলে যাবে কখনো ভাবতে পারিনি।

শুধু কৃষক বিজয় ঋষিই নয়, এমন চিত্র মেদির হাওর, আকাশি হাওর, আটাউরি বিল, বালিয়া বিলসহ পুরো এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের। তারা সরকারি কোনো ধরনের সহায়তা না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

হাওর পারের কৃষক জিলু চৌধুরী জানান, তার পরিবারের ৭০ কানি ধানি ফসলি জমি এখন পানির নিচে হাবুডুবু খাচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি দপ্তরের কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তিনি শুনেছেন, কারা কারা নাকি তালিকা প্রণয়ন করছেন।

নাসিরনগর সদরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আজদু মিয়া বলেন, ‘আমার জমিও পানির তলে। আমার এলাকার অনেকের জমির ওপর দিয়ে এখন নৌকা যায়। অনেক কৃষক একমাত্র ফসল ধান হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। কেউ এখনো ক্ষতিগ্রস্ত তালিকা প্রণয়ন করতে আমাকে জানায়নি বা এমন কোনো নির্দেশনাও আসেনি।’

তবে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. আবু সাইদ তারেক বলেন, ‘আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা প্রণয়ন করেছি। ইতোমধ্যে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে দুই হাজার ৫০ জনের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রয়োজনে এই তালিকা আরো সম্প্রসারণ করা হবে।’

এদিকে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেদী হাসান শাওন বলেন, ‘হাওর পাড়ে মাইকিং করে কৃষককে ৮০ ভাগ পরিপক্ব ধান কেটে আনার জন্য বলা হয়েছে। কৃষি বিভাগের সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সরকারি প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসা হবে।’