logo
আপডেট : ২৩ এপ্রিল, ২০২২ ১১:০৪
সেই হাজি মুসা ম্যানশন সিলগালা
এখনো বহাল ৪ সহস্রাধিক কেমিক্যাল গোডাউন
রুদ্র মিজান

এখনো বহাল ৪ সহস্রাধিক
কেমিক্যাল গোডাউন

পুরান ঢাকার একটি দোকানে রাসায়নিক সামগ্রী। -ফাইল ছবি

তখনো ভোর হয়নি। হঠাৎ করেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। কিছু বুঝে উঠার আগেই আগুন দাউ দাউ করে জ¦লতে থাকে। ‘আগুন আগুন আর বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার করছিলেন ভবনের বাসিন্দারা। চিৎকার করছিলেন আশপাশের লোকজন।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে বহুতল এই ভবনের গ্রিল কেটে উদ্ধার করে অনেককে। আগুনে ভস্মীভূত হয় ভবনের নিচতলা। ঘটনাস্থলেই মারা যান চারজন। পরবর্তী সময়ে মারা যান আরো দুজন।

আজ থেকে এক বছর আগে এভাবেই পুরান ঢাকার আরমানিটোলার হাজি মুসা ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তদন্তে প্রকাশ পায় ভবনটির নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত। অবৈধভাবে মজুদ রাখা রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের কারণেই এই আগুন মুহূর্তের মধ্যে ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

হাজি মুসা ম্যানশনে এখন রাসায়নিক পদার্থ নেই। ভবনটি তালাবদ্ধ করে রেখেছে সিটি করপোরেশন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা বিচারাধীন। হাজি মুসা ম্যানশনে রাসায়নিক পদার্থ না থাকলেও অভিযোগ রয়েছে আশপাশের বিভিন্ন বাসায় রয়েছে এই দাহ্য পদার্থ। বেশি টাকা পেয়ে অনেকেই রাসায়নিক কারবারিদের কাছে গোডাউন ভাড়া দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত বছরের ২৩ এপ্রিল অগ্নিকাণ্ডের পরদিন চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভেল ডিফেন্স অধিদপ্তর। ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক নূর হাসানকে প্রধান করে গঠিত চার সদস্যের কমিটি এটি তদন্ত করে।

১০ কার্যদিবসের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে এই কমিটি। এতে রাসায়নিক পদার্থ মজুদ রাখাকে অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়। এই ভবন নির্মাণে মানা হয়নি ফায়ার সার্ভিসের নিয়ম-নীতি। এসব কারণ এতে উল্লেখ করা হয়।

ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক নূর হাসান বলেন, যথানিয়মে প্রতিবেদন দিয়েছি। আগুনের সূত্রপাতসহ বিভিন্ন বিষয় এতে উঠে এসেছে। হাজি মুসা ম্যানশনসহ বেশির ভাগ ভবনই ফায়ার সার্ভিসের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই গড়ে উঠেছে বলে জানান তিনি।

হাজি মুসা ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আটজনকে আসামি করে বংশাল থানার উপ-পরিদর্শক মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে মামলা করেন। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর ছায়া তদন্তে নামে র‌্যাব। ঘটনার দুই দিন পর ২৬ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরা ও বগুড়ায় অভিযান চালিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান ও মোহাম্মদ মোস্তফাকে গ্রেপ্তার করে।

তারা দুজনেই মুসা ম্যানশনের নিচতলায় দুটি দোকান পরিচালনা করতেন। মঈন অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মোস্তাফিজুর রহমান এবং মেসার্স আরএস এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ মোস্তফা।

পরবর্তী সময়ে মুসা ম্যানশনের মালিক মোস্তাক আহমেদ চিশতীসহ অন্যরা আদালত থেকে জামিন নেন। ভয়াবহ এই ঘটনার এক বছর পূর্ণ হলেও আরমানিটোলাসহ পুরান ঢাকায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ঢাকায় কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে প্রায় ৫ হাজার। এরমধ্যে প্রায় ৪ হাজার গোডাউনই অবৈধ। এতে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন নেই। সবচেয়ে বেশি অবৈধ গোডাউন রয়েছে আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, চকবাজার, লালবাগ, ইসলামপুর ও চাঁনখারপুল এলাকায়।

এসব এলাকার প্রায় বাড়ির নিচতলায় দাহ্য পদার্থের গোডাউন ভাড়া দেওয়া হয়েছে। মূলত মালিকরা বেশি টাকার জন্যই এসব গোডাউন ভাড়া দেন। বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের পরপরই কিছুদিন সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কয়েক সংস্থা অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদ অভিযান চালায়।

কিছুদিন পর সেই অভিযানও থেমে যায়। সরকারি অসাধু কর্মকর্তাদের উৎকোচ দিয়েই পরিচালনা করা হয় এসব গোডাউন। বেশির ভাগ ব্যবসায়ী শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই কেমিক্যাল ব্যবসা করছেন। তারা চরম বিপজ্জনক কেমিক্যাল মজুদ, পরিবহন ও বিক্রির ক্ষেত্রে আইনের বাধ্যবাধকতা মানছেন না।

তবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাসায়নিক ব্যবসার জন্য নতুন ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। সর্বশেষ এসব লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে ২০১৯ সালে। এমনকি আগের লাইসেন্সও নবায়ন করেনি সিটি করপোরেশন। তারপরও চলছে এসব গোডাউন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কেমিক্যাল মজুদ করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে ‘কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ নির্মাণ করছে। এটি চালু হলে কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সেখানে স্থানান্তরিত করা হবে।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে প্রায় ১ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকাণ্ডের প্রায় সবগুলোর সূত্রপাত অরক্ষিত ও অবৈধভাবে গোডাউনে কেমিক্যাল মজুদের কারণে।

উদাহরণ হিসেবে রয়েছে, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউনের বিস্ফোরণে নিহত হয় ১২৭ জন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল গোডাউনে বিস্ফোরণে নিহত হয় ৭১ জন। এভাবেই বিপুল মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে অরক্ষিত কেমিক্যালের কারণে।

আবাসিক এলাকার এসব কেমিক্যাল গোডাউন এক-একটি যেন ভয়ংকর মৃত্যুকূপ।