logo
আপডেট : ২৩ এপ্রিল, ২০২২ ১২:১৪
আসন্ন বাজেট ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা
নিজস্ব প্রতিবেদক

আসন্ন বাজেট ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রাথমিকভাবে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকায় প্রাক্কলনে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, যা দেশের জিডিপির ১৫ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে এটি ৭৪ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে ঘোষিত বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা এবং সেই হিসাবে আগামী অর্থবছরে বাজেটের আকার বাড়ছে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। আসন্ন এই বাজেটে প্রাধান্য পাচ্ছে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাত। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দেওয়া হবে ভোক্তার হাতে অর্থপ্রবাহ বাড়ানোয় জন্য।


পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেতন-ভাতায় সরকারের ব্যয় ছিল ২৮ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৬৯ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ আরো বাড়িয়ে ৭৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই ব্যয় চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি। এদিকে আমদানি যে গতিতে বাড়ছে, রপ্তানির গতি সেই তুলনায় শ্লথ। এর মধ্যে আবার রেমিট্যান্সে ধারাবাহিকভাবে পতন হচ্ছে। এতে চাপে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আট মাসের ব্যবধানে ৪৮ বিলিয়ন থেকে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে রিজার্ভ। এ পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে ডলার খরচ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয়গুলো সাজানো হয়েছে। আগামী বাজেটে কোভিড-১৯ ছাড়াও বিশ্ব মূল্যস্ফীতির প্রভাব কঠোরভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৯ জুন মহান জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করবেন, যা হবে এটি স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম এবং বর্তমান সরকারের টানা ১৪তম ও অর্থমন্ত্রীর চতুর্থ বাজেট।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আগামী অর্থবছরে মোট আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে মোট আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে মোট আয় বাড়ছে ১১ শতাংশ। মোট আয়ের মধ্যে এনবি আরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা জিডিপির ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এনবি আরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া আছে। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা ৪০ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ১২ শতাংশ বাড়ছে। এ ছাড়া আগামী বাজেটে মোট আয়ের মধ্যে নন-এনবি আর থেকে প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা।


করবহিভূর্ত রাজস্ব ৪৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সে হিসাবে অর্থ মন্ত্রণালয় আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটে ভতুর্কি ব্যয় আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। আগামী অর্থবছরের জন্য ইতিমধ্যে ৬০ হাজার কোটি টাকা ভতুর্কির প্রাথমিক প্রাক্কলন করেছে মন্ত্রণালয়। তবে চূড়ান্ত বাজেটে এর পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। সার, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে এবং তা সমন্বয় করা না হলে বাজেটে এই ব্যয় আরো বাড়ানো ছাড়া সরকারের কাছে কোনো উপায় থাকবে না বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে আইএমএফের মতে, ভতুর্কির টাকা কমানো গেলে সরকার তা অন্য উন্নয়নকাজে ব্যয় করতে পারে। তবে সরকার বলছে, ভতুর্কির পরিমাণ না বাড়ালে কৃষিপণ্য, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আরো বাড়বে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। চলতি অর্থবছরের বাজেটে কৃষি, রপ্তানিসহ বিভিন্ন খাতে সব মিলিয়ে ৪৮ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা ভতুর্কি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা মোট বাজেটের প্রায় ৮ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ। বাজেটে এটি দেখানো হয়েছে ভতুর্কি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ হিসেবে। গত অর্থবছরের বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ৪৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তার আগের অর্থবছরে, অর্থাৎ ২০১৯-২০-এর বাজেটে ভতুর্কির পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভতুর্কির পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভতুর্কির পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে থাকায় গত ৩ নভেম্বর দেশেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। এবং এবার সরকার চাইছে ভতুর্কি কমানোর লক্ষ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়াতে। সরকারের যুক্তি হলো, এই তিন পণ্যের দাম সমন্বয় বা বৃদ্ধি করা না হলে বাজেটে ভতুর্কি ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে, যার পরিমাণ হতে পারে জিডিপির ২ শতাংশ। অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা, সারে ২৫ হাজার কোটি টাকা ভতুর্কির প্রয়োজন হবে আর এলএনজিতে ভতুর্কির প্রয়োজন হবে ১০ হাজার কোটি টাকা। যদিও শেষ পর্যন্ত কৃষকদের ওপর বাড়তি চাপের কথা বিবেচনা করে সারের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসতে পারে সরকার। তার পরও চলতি অর্থবছরেই আরো বাড়তি ৪৫ হাজার কোটি টাকা লাগার আশঙ্কা করা হচ্ছে।


কর্মসংস্থান বাড়াতে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণয়ন করছে সরকার। এতে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন। ফলে দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে। ব্যবসায়ীদের ওপর করের বোঝা না চাপিয়ে বরং করের আওতা বাড়াতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। সম্প্রতি বাজেট-সংক্রান্ত এক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, করোনা মহামারি থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণয়নে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। কর বাড়াতে হলে আগে হয়রানি বন্ধ করে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ দিতে হবে। এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত ৪২তম পরামর্শক সভায় এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলেন, ব্যবসায়ীরা যাতে হয়রানিমুক্ত থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন, সেদিকে সবার দৃষ্টি দিতে হবে। আমদানিকৃত কাঁচামাল, মধ্যবর্তী কাঁচামালসহ যাবতীয় শিল্প উপকরণের ওপর আরোপিত অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আয়কর ও মূসকের আওতা বাড়ানো, সব রপ্তানি খাতকে সমান সুবিধা দেওয়া, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি জোরদার করা, টার্নওভার কর ফিরিয়ে আনা, বিদ্যমান ভ্যাট আইন সংশোধন করার প্রস্তাবও এসেছে।
বাংলাদেশকে ২৫ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। করোনা অভিঘাতের মধ্যে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের সংক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষমতা অর্জনে এ অর্থ কাজে লাগানো হবে। বাংলাদেশ ফার্স্ট রিকভারি অ্যান্ড রেজিল্যান্স ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিট (ডিপিসি) সিরিজের আওতায় এই ঋণ দেওয়া হচ্ছে। সিরিজে দুই কিস্তিতে মোট ৫০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা। চলতি ২০২১-২২ এবং আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট সহায়তা হিসেবে এই অর্থ পাচ্ছে বাংলাদেশ। করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে আর্থিক উদ্দীপনায় সহায়তা এবং আগামীর ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ডিপিসি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের এই ঋণে সুদের হার ধরা হয়েছে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ। এর সঙ্গে সার্ভিস চার্জ হিসেবে শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ যুক্ত হবে। পাঁচ বছরের রেয়াতকালসহ এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হলো, প্রতি বছর দেখা যায় প্রথমে বাজেটের যে আকার ধরা হয়, সংশোধিত বাজেটে তা অনেকটা কমানো হয়। তার পরও প্রকৃত ব্যয় সংশোধিত বাজেটের চেয়েও কম হয়। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোসহ বেশ কিছু প্রণোদনা বাড়ানো ও ভতুর্কি বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকারের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এমনিতেই বড় ভতুর্কির চাপে পড়তে হয়েছে সরকারকে এবং আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব থাকছে। আগামী বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাড়তি ভতুর্কির চাহিদা। চলতি বাজেটে শুধু ভতুর্কি খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকা। আগামী বাজেটে সেটা বেড়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতামত হলো, আসন্ন বাজেটের আর্থিক কাঠামো প্রস্তুত করা অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় কষ্টকর। কারণ ব্যয়ের বড় দুটি অংশ যাবে ভতুর্কি প্রণোদনা ও সুদ পরিশোধে। এ দুই খাতে প্রায় ৫৭ শতাংশ ব্যয় হবে। এর সঙ্গে বেতন-ভাতাসহ সরকারের অন্যান্য পরিচালন ব্যয় যোগ করলে সেটা ৯০ শতাংশের ওপরে চলে যাবে। তাই উন্নয়নমূলক কাজকর্ম করার জন্য অর্থ খুব কমই থাকবে, যা হবে আগামী বাজেটের সবচেয়ে বড় সমস্যা।


লেখক: অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন গবেষক