logo
আপডেট : ২৪ এপ্রিল, ২০২২ ০৯:১১
ভুল চিকিৎসার আতঙ্কে সাধারণ মানুষ
নিখিল মানখিন

ভুল চিকিৎসার আতঙ্কে সাধারণ মানুষ

ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং আইনগত প্রতিকারের জন্য এখনো বাংলাদেশে একক কোনো আইন কার্যকর নেই।

ভুল চিকিৎসার আতঙ্কে সাধারণ মানুষ। ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ ও মামলার বিষয়টি আজ স্বাভাবিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে। অভিযোগ তোলার সুযোগ পান না অনেক অসহায় রোগীর স্বজনরা। এতে দেশের চিকিৎসাসেবার ওপর সাধারণের আস্থা কমে যাচ্ছে। এ অভিযোগকে কেন্দ্র করে প্রায়ই চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রোগীর স্বজনদের বাদানুবাদ, ভাঙচুর এবং উভয়পক্ষে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার খবর পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ‘আস্থা’ ধরে রাখতে না পারলে ভবিষ্যতে মারাত্মক সমস্যায় পড়বে দেশের চিকিৎসা সেক্টর। বেড়ে যাবে চিকিৎসার জন্য বিদেশগামী রোগীর সংখ্যা। চিকিৎসা সেক্টরে অরাজকতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে আশঙ্ক প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল বলতে শুধু চিকিৎসকের অবহেলা নয়, বরং চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা; যেমন নার্স, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদন ও সরবরাহকারীদের অবহেলাও বোঝানো হয়। ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং আইনগত প্রতিকারের জন্য এখনো বাংলাদেশে একক কোনো আইন কার্যকর নেই। বাংলাদেশে ২০১৬ সালে ‘রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন’ নামের একটি আইন প্রস্তাব করে সরকার। কিন্তু এ আইনটি এখনো কার্যকর হয়নি। তবে বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত আইনে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে আইনি প্রতিকারের সুযোগ রয়েছে। গত ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় জুয়েল মিয়া (৩০) নামে এক পোলট্রি ব্যবসায়ীকে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর মামলায় ২ চিকিৎসকসহ তিনজনকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। এছাড়া ৫ লাখ টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে আরো এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

মামলার এজাহার ও নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে ৫ জুলাই পোলট্রি ব্যবসায়ী জুয়েল মিয়া ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে ট্রমা হাসপাতালের অর্থোপেডিক চিকিৎসক ডা. কামরুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে হাতের অস্ত্রোপচার করতে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে অ্যানেস্থেসিয়া (অজ্ঞান) চিকিৎসক না থাকায় হাসপাতালের সহকারী গৌরাঙ্গ সাহা রোগীকে অ্যানেস্থেসিয়ারর ওষুধ প্রয়োগ করেন। পরে অস্ত্রোপচার করার পর রোগীর জ্ঞান না ফেরায় অপারেশন থিয়েটারেই রোগীর মৃত্যু হয়। কিন্তু রোগীর জ্ঞান ফিরে না আসায় সন্দেহ হলে স্বজনরা রোগীর কাছে যেতে চাইলে তাদের অপারেশন থিয়েটারে যেতে না দিয়ে মৃত রোগীকে জীবিত আছে বলে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে রোগীর স্বজনরা অপারেশন থিয়েটারে জোর করে ঢুকে দেখেন রোগী মারা গেছেন।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে মানিকগঞ্জ পৌরসভার জয়নগর এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় সাগর খান নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইনি ঝামেলা এড়াতে ৪ লাখ টাকায় মৃতের পরিবারের সঙ্গে সমঝোতা করে। ওই সময় নিহতের বাবা হারুন খান জানান, সাগরের পেটে ব্যথা হলে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক জানান, সাগরের অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সাগরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সন্ধ্যায় তার অস্ত্রোপচার করা হয়। তাদের না জানিয়েই সাগরকে সাভারের আরেকটি বেসরকারি অইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করে সুপার মেডিকেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সাগর সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সাগরের বাবা। নেত্রনালি অস্ত্রোপচার না করে চোখের ছানি অপারেশন করে কৃত্রিম ল্যান্স লাগিয়ে দেওয়ায় চট্টগ্রামের লায়ন্স হাসপাতালের এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি খুলশী থানায় ভুল চিকিৎসার শিকার রোগীর ভাই আবুল হোসেন আকাশ বাদী হয়ে এ মামলা করেন। ভুল চিকিৎসার শিকার রোগীর নাম হালিমা। তার বাসা নগরের দেওয়ানহাট এলাকায় এবং গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে।

স্বাস্থ্য অভাবে দেশের বাইরে চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সাংবাদিক আরিফ সাওন। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, আমি কোমরে ব্যথা নিয়ে প্রথমে ব্যথার ওষুধ খাই। না কমায় আমি একজন নিউরোর ডাক্তার দেখাই। তিনি কিছু কিছু ওষুধ দেন। তাতে অবস্থার উন্নতি হয়নি। পরে ফিজিক্যাল মেডিসিনের ডাক্তার দেখাই। তিনি এমআরআই করিয়ে তারপর থেপারি নিতে বলেন। তাতে উন্নতি হয়নি। কয়েক মাস পরপর খুব যখন বাড়তে থাকে তখন অর্থো সার্জন দেখাই। তিনি নিউরো সার্জনের কাছে পাঠান। রিপোর্ট দেখে অপারেশনে পরামর্শ দেন। এরপর আবার আরেকজন অর্থোপেটিক্সের ডাক্তার দেখাই। তিনি থেরাপির পরামর্শ দেন। কাজ না হলে অপারেশন করতে হবে বলে জানান। যেখানে থেরাপির নিতে গেছি তিনি সব কিছু বাদ দিয়ে নিজের মতো করে ওষুধ লিখেছেন। নিজের মতো করে ট্রিটমেন্ট দিয়েছেন। সঙ্গে আদের ডাক্তারদেরও বদনাম করেছেন। আমার অভিজ্ঞতা হলো যখন যে ডাক্তারের কাছে গেছি, তিনি আগের ডাক্তারে ওষুধ রাখেননি। না রেখে নিজের মতো করে ওষুধ দিয়েছেন। যে ডাক্তার যে বিষয়ে দক্ষ আমরা রোগটাও সেই রিলেটেন মনে করেছেন। এসব অভিজ্ঞতার কারণে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান আরিফ সাওন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘চিকিৎসা ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা থাকে। আমাদের দেশে জটিলতা যেমন আছে, তেমনি উন্নত দেশেও কিছু কিছু জটিলতা হয়। ভুল ডায়াগনসিসও হয়ে থাকে। হয়তো আমাদের এখানে একটু বেশি। তাছাড়া আমাদের চিকিৎসকদের অধিকসংখ্যক রোগীকে সামলাতে হয়। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমাদের দেশ হয়তো উন্নত দেশের তুলনায় ৫০ বছর পেছনে। বিশে^ এখন নতুন নতুন পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয় হচ্ছে। আস্তে আস্তে আমরাও উন্নত রোগ নির্ণয় ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে আমাদের বিনিয়োগ একটা প্রধান ঘাটতি।’ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, ‘চিকিৎসকের কাছ থেকে রোগীদের সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে। যদি তারা সঠিক চিকিৎসা না পায়, তাহলে বিএমডিসিতে অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে। অভিযোগগুলো একটি শৃঙ্খলা কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে সমাধান করা হয়।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, ‘চিকিৎসাশাস্ত্র একটি স্পর্শকাতর ক্ষেত্র। চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে না- এমন কথা বলতে পারব না। তবে প্রকৃত চিকিৎসক, নার্স এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ইচ্ছেকৃতভাবে চিকিৎসাসেবা প্রদানে ভুল করেন না। কিছুসংখ্যক অসাধু চিকিৎসক, নার্স, টেকনিসিয়ান, স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, যারা ব্যবসায়িক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তাদের দ্বারা রোগীর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’